জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে রাজশাহীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন সালাউদ্দিন আম্মার। সরকার পতনের পরও নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এ সমন্বয়ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে কোনো আন্দোলনে তার সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
আসন্ন রাকসু নির্বাচনে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে লড়ছেন তিনি। নির্বাচনী আমেজের মধ্যেই হঠাৎ পোষ্য কোটাবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ক্যাম্পাস। সেখানেও শিক্ষকদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে নতুন করে আলোচনায় সালাউদ্দিন আম্মার।
রাকসু নির্বাচন ও ক্যাম্পাসের চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আল-আমিন হাসান আদিব।
জাগো নিউজ: রাকসু নির্বাচনের মাত্র দুদিন বাকি। কিন্তু পোষ্য কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সবার নজর ভিন্ন দিকে। কর্মবিরতিতে শিক্ষক-কর্মকর্তারা। ক্যাম্পাসে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায়ও ভাটা দেখা যাচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা কতটা করতে পেরেছেন?
সালাউদ্দিন আম্মার: মীমাংসিত একটি ইস্যু পোষ্য কোটা। হঠাৎ এটা বহাল করে একটি পক্ষ রাকসু নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছে বলে আমরা মনে করি। পোষ্য কোটা ইস্যুতে আন্দোলন করতে গিয়ে নানা ঘটনায় আমরা রাকসুর প্রচার-প্রচারণায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি। এ আন্দোলনে আমাদের প্যানেল লাভবান হয়নি, বরং অনেকাংশে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
এ ধরনের নির্বাচনের জন্য মানসিক একটি প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে। সেটাতে আমাদের বড় ঘাটতি হয়ে গেছে। এখন যে পরিস্থিতিতে আছি, শেষ সময়ে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীরা যদি আমাদের এ কার্যক্রমকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে আমরা তাদের জন্য লড়ে যাবো।
আমরা কিন্তু তাদের (শিক্ষক) কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এখনো চাচ্ছি, যতবার চাইতে বলবেন চাইবো। কারণ তারা আমাদের শিক্ষক। হ্যাঁ, সেখানে ধস্তাধস্তির একটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এটাকে ফ্রেমিং করা হয়েছে ভিন্নভাবে
জাগো নিউজ: পোষ্য কোটা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে আপনি ও আপনার সমর্থক একদল শিক্ষার্থী হাতাহাতিতে জড়িয়েছেন। এ নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেগুলো আপনারা কী মেনে নিয়েছেন?
সালাউদ্দিন আম্মার: প্রথম ব্যাপারটা হচ্ছে, তারা (বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন) পোষ্য কোটায় ভর্তি স্থগিত করেছেন। এটা কোন প্রক্রিয়ায় স্থগিত করেছেন? স্থায়ীভাবে নাকি সাময়িক? তাদের স্থগিতাদেশ যদি শুধু রাকসু নির্বাচন পর্যন্ত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কোনোভাবেই মেনে নেবো না। রাকসুতে যারা বিজয়ী হবেন, সে নির্বাচিত নেতাদের মাধ্যমে আমরা পোষ্য কোটা বাতিলে প্রশাসনকে চাপ দেবো। কোনো পোষ্য কোটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখতে দেওয়া হবে না।
জাগো নিউজ: উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শিক্ষকদের হেনস্তার ঘটনার মূল চরিত্রে আপনি বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কমিটি করেছে। তারা যদি তদন্ত শেষে আপনার ও আপনার অনুসারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে, সেক্ষেত্রে আপনারা কী করবেন?
সালাউদ্দিন আম্মার: আমরা কিন্তু তাদের (শিক্ষক) কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এখনো চাচ্ছি, যতবার চাইতে বলবেন চাইবো। কারণ তারা আমাদের শিক্ষক। হ্যাঁ, সেখানে ধস্তাধস্তির একটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এটাকে ফ্রেমিং করা হয়েছে ভিন্নভাবে।
আরও পড়ুন
উপ-রেজিস্ট্রারের দাড়ি ধরে টান, সিঁড়িতে ফেলে দেওয়া হয় প্রোভিসিকে
নীতি-আদর্শ-শৃঙ্খলা দেখে হিন্দু হয়েও শিবিরের প্যানেলে এসেছি
পোষ্য কোটা ইস্যুতে উত্তাল রাবি, প্রোভিসিকে দুই দফা অবরুদ্ধ
কোটা ইস্যুতে থমথমে রাবি ক্যাম্পাস, নেই রাকসুর প্রচারণাও
এখন এ ঘটনা তদন্ত করে একপাক্ষিক কোনো সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিলে বা শিক্ষার্থীদের শাস্তির মুখোমুখি করলে সেটা মেনে নেওয়া হবে না। আমরা চাই, এ ইস্যুতে যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নতুন করে মুখোমুখি করা না হয়।
আমি দাড়ি ধরিনি বা দাড়ি ধরার কোনো অভিপ্রায়ও ছিল না। ভিডিওতে দেখবেন, একজন শিক্ষক আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি তখন ওই কর্মকর্তার পাঞ্জাবি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। সেটা ভিডিওতে একপাশ থেকে মনে হচ্ছে যেন দাড়ি ধরে টানছি
জাগো নিউজ: ধস্তাধস্তির সময় আপনারা শিক্ষকদের টানাহ্যাঁচড়া করেছেন। এমনকি একজন উপ-রেজিস্ট্রারের দাড়ি ধরে টান দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
সালাউদ্দিন আম্মার: প্রথমত, আমি দাড়ি ধরিনি বা দাড়ি ধরার কোনো অভিপ্রায়ও ছিল না। ভিডিওতে দেখবেন, একজন শিক্ষক আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি তখন ওই কর্মকর্তার পাঞ্জাবি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। সেটা ভিডিওতে একপাশ থেকে মনে হচ্ছে যেন দাড়ি ধরে টানছি।
আর উপ-উপাচার্যের সঙ্গে যে ঘটনাগুলো হয়েছে, সেখানে আমি কোনো অ্যাগ্রেসিভ (উগ্র) আচরণ করিনি। আমার পক্ষ থেকে এটা বলতে পারি যে, আমি শুধু স্যারকে বারবার আটকে রাখার চেষ্টা করেছি; দুই হাত প্রসারিত করে স্যারকে জুবেরি ভবনের ভিতরে প্রবেশে বাধা দিয়েছি। আমরা যে দাবি জানিয়েছি, তা আদায় করতে চেয়েছি।
জাগো নিউজ: কিন্তু আপনার সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা তো উপ-উপাচার্যকে সিঁড়িতে টেনে বসিয়ে দেন। তারপর আবার দোতলা থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে নামানোর চেষ্টা করেন; সেগুলো ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে..। এর দায় কার?
সালাউদ্দিন আম্মার: হ্যাঁ, এটা তো সত্য যে দায়টা অবশ্যই লিডিং পজিশনে (নেতৃত্বে) যারা থাকেন, তাদের নিতে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যারা আমার সঙ্গে ছিলেন, তারা আন্দোলনকারী; তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। আন্দোলন চলাকালে একটা পরিস্থিতিতে তারা হয়তো এটা করে ফেলেছেন। তবে আমার দ্বারা কোনো শিক্ষক লাঞ্ছিত হননি।
বরং প্রো-ভিসি স্যার আমার গলা টিপে ধরেছেন। তিনি ধাক্কা দিয়েছেন। এগুলো আমি আলোচনায় আনতে চাই না। ইস্যুও করতে চাইনি। তবে আমার কনসার্নের জায়গা হলো পোষ্য কোটা বাতিল করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমি আমার দাবির প্রতি অটল থেকেছি।
আমার বাবা জামায়াতের রাজনীতি করেন। আমি তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় পড়েছি। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। এজন্য আমি নিজেকে এনভায়রনমেন্টাল (পরিবেশগত) শিবির মনে করি
জাগো নিউজ: সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে আপনাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, শিবির তিন ধরনের। এনভায়রনমেন্টাল, এডুকেশনাল ও সিচুয়েশনাল। আপনি কোন ধরনের শিবির?
সালাউদ্দিন আম্মার: দেখুন, আমার বাবা জামায়াতের রাজনীতি করেন। আমি তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় পড়েছি। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। এজন্য আমি নিজেকে এনভায়রনমেন্টাল (পরিবেশগত) শিবির মনে করি। পরিবার থেকে জামায়াত বা শিবিরের পরিবেশ পেয়েছি। যেখানে পড়ালেখা করেছি, সেই তামিরুল মিল্লাতে তো সবকিছুই হয় শিবিরের হাত ধরে।
কিন্তু কখনো কোনো বিষয়ে বায়াসড বা ইথিক্যাল জায়গা থেকে একেবারে টোটালি শিবিরকে অ্যাকসেপ্ট করতে হবে, তা করিনি। তাদের সিলেবাসে লেখাপড়া করা হয়নি; তাদের পদ-পদবি নিয়ে শিবির হওয়ার যে বিষয়গুলো, সেটাতে যুক্ত হইনি।
শিবিরের কালচারাল উইংগুলোতে আমি কাজ করেছি। একজন ফিল্ম মেকার হিসেবে তাদের কালচারাল উইংয়ে বেশ কিছুদিন ছিলাম। তামিরুল মিল্লাতে থাকাকালে তাদের ব্যানারে অনেক ইভেন্ট নামিয়েছি। ওখানে তো ব্যানার একটাই ছাত্রশিবিরের। তার বাইরে কোনো ব্যানার নেই।
জাগো নিউজ: বলছিলেন আপনার বাবাও জামায়াতের রাজনীতি করেন। তিনি জামায়াতের কোথায়, কী পদে আছেন?
সালাউদ্দিন আম্মার: আমার বাবা জামায়াতের কোনো বড় পদ-পদবিতে নেই। তিনি অনেক আগে থেকে জামায়াতের সমর্থক। আমার গ্রামের বাড়ি খুলনায়। সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে তিনি জামায়াতের সমর্থক। এর বেশি কিছু নয়।
হ্যাঁ, যদি কেউ মনে করে যে, ‘এ’ টিমের তুলনায় ‘বি’ টিম শক্তিশালী, তাহলে তো ভিন্ন কথা। আমরাও বলছি, রাকসু নির্বাচনে সর্বোচ্চ ফাইটটা আমরা দেবো। কেউ কারও জায়গা থেকে বসে নেই
জাগো নিউজ: আপনার শিবির-সংশ্লিষ্টতার কারণে আপনাদের যে প্যানেল; সেটাকে রাকসু নির্বাচনে শিবিরের ‘বি’ টিম বলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী?
সালাউদ্দিন আম্মার: এটা স্পষ্টত ট্যাগিং পলিসি। অনেক ক্ষেত্রে এ ট্যাগটা তারাই (শিবির) দিচ্ছেন, যাদের দলের (শিবির) নামে ট্যাগটা দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ‘এ’ টিম বা ‘বি’ টিম- এ ধরনের আলাপ তোলা অনুচিত; ট্যাগিংটা একেবারেই ভুল। কেউ কখনো চাইবে না যে, তার সুসময়ে ‘এ’ টিম রেখে ‘বি’ টিমকে জিতিয়ে আনবে।
হ্যাঁ, যদি কেউ মনে করে যে, ‘এ’ টিমের তুলনায় ‘বি’ টিম শক্তিশালী, তাহলে তো ভিন্ন কথা। আমরাও বলছি, রাকসু নির্বাচনে সর্বোচ্চ ফাইটটা আমরা দেবো। কেউ কারও জায়গা থেকে বসে নেই। সবাই সর্বোচ্চটা উজাড় করে কাজ করছে। এজন্য ‘এ-বি’ টিম আলাপ তোলাই উচিত না। এটা ট্যাগিং কালচার। এটা দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভাজিত করার চেষ্টা হচ্ছে, বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ: আপনার প্যানেলের কয়েকজন সরে দাঁড়িয়েছেন। জিএস পদে আপনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত। পোষ্য কোটা ইস্যুতে তাতে কি ভাটা পড়লো? এর ফলে জিএস পদে জয়ী হওয়ার পথ কঠিন হলো কি না?
সালাউদ্দিন আম্মার: আমি মনে করি, আল্লাহ চাইলে আমি রাকসুর জিএস হবো। শিক্ষার্থীরা যদি আমার প্রতি বিশ্বাস রাখেন, তাদের সঙ্গে নিয়ে জুলাই আন্দোলন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যত কাজ করেছি; তা আরও বেশি করতে পারবো। দিনশেষে আমি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখি। আল্লাহ চাইলে সালাউদ্দিন আম্মার জিএস পদে জিতবে।
জাগো নিউজ: জুলাই আন্দোলনে রাজশাহীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন আপনি। এরপর কিছু মব ভায়োলেন্স, ক্যাম্পাসে আন্দোলন, ছাত্রলীগ নেতা হত্যাকাণ্ড, কনসার্টের জন্য ডোনেশন কালেকশন ইস্যুতে পুরো সময় রাজশাহীতে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে সালাউদ্দিন আম্মার। এটিকে কীভাবে দেখেন?
সালাউদ্দিন আম্মার: যখন কেউ কাজ করবেন, তার বিপরীতে অবশ্যই একটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যাবে, শত্রুও বাড়বে। আমাকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে, বিতর্ক বেড়েছে। আমি যখন কাজ করবো না, তখন আমাকে নিয়ে সমালোচনা হবে না। যখন আমি দেখছি, আমাকে নিয়ে কিছু সমালোচনা হচ্ছে, তখন আমি বুঝতে পারছি কিছু না কিছু কাজ আমাকে দিয়ে হচ্ছে। কারা এ বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছেন। তারাই জবাব দিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে নিজে থেকে কোনো বিষয়ে জবাব দিতে হচ্ছে না।
এএএইচ/এএসএ/এমএস