বায়ুদূষণের ফাঁদে শিশু, শ্রমজীবীরা

3 hours ago 4

ঢাকার ভোর মানেই ধুলোয় ঢাকা রাস্তাঘাট। দিনের আলো ফুটতেই ফ্লাইওভার, বাসস্ট্যান্ড, বাজার কিংবা নির্মাণাধীন সড়কের ধারে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া আর ধুলা। এই শহরের হাজারো মানুষ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ ধুলাবালির মাঝেই জীবনযাপন করছেন। কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ হকারি করছেন, কেউবা দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। দূষিত এই বাতাস গিলেই চলছে তাদের নিত্যদিন। যেন নিঃশ্বাসের ভেতরেই জমছে অদৃশ্য বিষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বের সাত মিলিয়নের বেশি মানুষ প্রতিবছর অকাল মৃত্যুর শিকার হন শুধু বায়ুদূষণের কারণে। বাংলাদেশে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। ঢাকা বহু বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়, বাড়ে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি। অথচ রাজধানীর রাস্তায় প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু ভ্যানগাড়ি, টোকাই বা হকারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে এই বিষাক্ত বাতাসের ভেতরেই।

এমন বাস্তবতায় প্রতি বছর ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘নীল আকাশের জন্য আন্তর্জাতিক পরিষ্কার বায়ু দিবস’। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসের লক্ষ্য হলো বিশ্ববাসীকে বায়ুদূষণ রোধে সচেতন করা, সবার জন্য টেকসই ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু রাস্তায় থাকা মানুষের জীবনে এই দিবসের বার্তা যেন এখনো পৌঁছায়নি। তাদের জন্য প্রতিদিনই নতুন এক পরীক্ষার দিন। ধুলা ও ধোঁয়ার ভেতরে ফুসফুস বাঁচিয়ে রাখার দিন!

রোজগারের তাগিদেই হোক বা জীবিকার অভাবে, এসব মানুষ দিনের বেশিরভাগ সময় খোলা রাস্তায় কাটান। একটি সিগন্যাল অতিক্রমের সময় গাড়ির কালো ধোঁয়া তাদের মুখে এসে আছড়ে পড়ে। আবার নির্মাণসামগ্রীর ট্রাক বা সিমেন্টের বস্তা খোলার সময় ধুলায় ভরে যায় চারপাশ। এতে বাড়ে শ্বাসকষ্ট ,থামেনা কাশি। তবুও জীবনের তাগিদে কাজে ছোটেন নগরের ব্যস্ত মানুষগুলো।

শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নন, শিশুদের অবস্থাও কম ভয়াবহ নয়। সড়কের পাশে ফুল, টিস্যু কিংবা পানির বোতল বিক্রি করা ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সারাদিনের সঙ্গী হচ্ছে ধোঁয়া-ধুলা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তায় কাজ করা শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও চর্মরোগের হার স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে দ্বিগুণ।

চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এমন দূষিত বাতাসে থাকার ফলে মানুষের ফুসফুসে ক্ষতি হয় স্থায়ীভাবে। ব্রংকাইটিস, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ এমনকি ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা, যারা প্রতিদিন খোলা রাস্তায় শারীরিক শ্রম দেন।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীরা বলছেন, দূষণের মূল উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গাড়ির কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার নির্গমন, ইটভাটা ও নির্মাণসামগ্রীর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। বাংলাদেশেও একই চিত্র বিরাজমান। যদিও সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা দূষণ কমাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন: ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, পুরোনো গাড়ি সরানো, গাছ লাগানো কিন্তু বাস্তবে তা পর্যাপ্ত নয়।

রাস্তায় থাকা মানুষদের জন্য কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। তারা মাস্ক পরে না, বা পেলেও তা টিকে না ঘাম, ধুলা আর পরিশ্রমের ভেতরে। তাই প্রয়োজন সচেতনতা এবং সরকারি উদ্যোগের সমন্বয়। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে ঢাকনা ব্যবহার, সড়ক নিয়মিত পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার রাখা এবং গণপরিবহনে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

কিন্তু এর বাইরেও দরকার সামাজিক দায়িত্ববোধ। আমরা যারা অফিস-বাসায় এয়ার কন্ডিশনারের মধ্যে সময় কাটাই, তাদের উচিত রাস্তায় থাকা মানুষদের দুর্দশা উপলব্ধি করা। কারণ এই দূষণ কেবল হকার, রিকশাচালক বা শ্রমিককে আক্রান্ত করছে না; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সবার জীবনে।

ঢাকার আকাশ যখন ধুলায় নীল রং হারায়, তখন রাস্তায় থাকা মানুষদের নিঃশ্বাস হয়ে ওঠে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য এই শহর শুধু রোজগারের জায়গা না, প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার লড়াইও।

আজকের দিনে, যখন ‘পরিষ্কার বাতাসের আন্তর্জাতিক দিবস’ পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো এই রাস্তায় থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকানো। তাদের নিঃশ্বাস বাঁচাতে পারলেই হয়তো একদিন আমরা সত্যিকার অর্থেই নীল আকাশ দেখতে পাব।

তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, ইউনিসেফ, ইউএনইপি, আইকিউএয়ার

কেএসকে/জিকেএস

Read Entire Article