‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, ছাত্রদের অনাগ্রহ, অস্পষ্টতায় জামায়াত’

1 day ago 9

দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করছে, কারণ আওয়ামী লীগ এখন একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুতরাং বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, ছাত্ররা তেমন আগ্রহী নয় এবং জামায়াতে ইসলামী, যারা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর, তারা দ্বিধাগ্রস্ত—তারা অপেক্ষা করতে রাজি, ১০-১৫ বছরও অপেক্ষা করতে রাজি। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে যদি হয়, কিন্তু স্থগিত হলেও তাদের তেমন সমস্যা নেই। এটাই এখন পরিস্থিতি।’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের ‘নাথিং বাট ট্রু’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বাংলাদেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকটির সম্পাদক মাহফুজ আনামকে। রাজ চেঙ্গাপ্পার উপস্থাপনায় ওই অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনাম বাংলাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এভাবে ব্যাখ্যা করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে রাজ চেঙ্গাপ্পা বলেন, গত বছরের আগস্টে বিশাল ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত হন। এরপর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, ‘ভারত মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় নিপীড়ন প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এনেছে এবং তাদের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা চেয়েছে। এ ছাড়া ভারত বাংলাদেশে ইসলামিকরণ বৃদ্ধি এবং পররাষ্ট্রনীতিতে দেশটির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।’

‘এদিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের কার্যক্রম মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে।’ এমন দাবি করেন তিনি।

রাজ চেঙ্গাপ্পা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইউনূস সরকার দাবি করছে, তারা অর্থনৈতিক পতন রোধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং রাজনৈতিক, বিচার বিভাগীয় ও শাসন সংস্কার চালু করছে। তবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিদেশি বিনিয়োগের অভাব, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এবং দীর্ঘস্থায়ী বেকারত্ব সমস্যাগুলো নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।’

তিনি আরও দাবি করে বলেন, ‘এ ছাড়া অনেকের ধারণা যে ইউনূস মৌলবাদী ইসলামপন্থী ছাত্রগোষ্ঠীর হাতের পুতুল, যারা সরকারের মৌলিক নীতিগুলো পরিবর্তন করছে। এটি অন্যতম প্রধান সমালোচনার বিষয়।’

‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সতর্ক করে দিয়েছেন, দেশ “নৈরাজ্যের অবস্থায়” রয়েছে এবং যদি রাজনৈতিক বিভাজন ও অস্থিরতা চলতে থাকে, তাহলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।’

রাজ সার্বিক বিষয়ে জানতে মাহফুজ আনামের কাছে জানতে চান, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব নেওয়ার সাত মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তাকে মনোনীত করা হয়েছিল এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শাসনব্যবস্থা, নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কার আনবেন। আপনি এই বিষয়গুলোর ওপর ইউনূসের কর্মদক্ষতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?’

উত্তরে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘শুরুতেই আমি তাকে মিশ্র গ্রেড দেব। কিছু ক্ষেত্রে তিনি খুব ভালো করেছেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম করেছেন। আর এটা বুঝতে হবে যে হাসিনা সরকার ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তিনি ছিলেন খুব শক্তিশালী নেত্রী এবং তিনি চলে যাওয়ায় ক্ষমতার একটি শূন্যতা তৈরি হয়। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ইউনূস প্যারিসে ছিলেন, তিনি ৮ আগস্ট দেশে ফিরেছিলেন এবং হাসিনা ৫ আগস্ট চলে যান দেশ ছেড়ে। মাঝের এই তিন দিন আমাদের দেশে কোনো সরকার ছিল না। এই তিন দিনই সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা এবং আক্রমণের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি।’

‘কিছু কারাগার থেকে বন্দিরা পালিয়েছিল, কিছু মৌলবাদী কারাগার থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। তাই এই প্রথম কয়েক দিনে অনেক বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর ইউনূস শপথ নেন, তার প্রাথমিক দলের সদস্যরা বেশ যথেচ্ছভাবে নির্বাচিত হয়েছিল। আমি জানি, তিনি অনেককেই ব্যক্তিগতভাবে জানতেন না। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে তিনি তাদের মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন, যাদের তিনি ভালোভাবে জানেন না। এ নিয়ে অনেক অস্বস্তি ছিল, বলতে পারেন মিশ্র একটি দল। যারা একে অপরের সঙ্গে কখনো কাজ করেননি এবং তাদের অনেকেরই সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না।’

‘সুতরাং বলা যায়, শুরুতে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ভুল দিকনির্দেশনা এবং কিছু নীতির অভাব ছিল। সাত মাস পর এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল হয়েছে পরিস্থিতি। এ ছাড়া শুরুতে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল, যা এখন স্থিতিশীল। আমরা গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমতে দেখেছি এবং আমাদের রপ্তানি এখন আগের স্তরে ফিরে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর আমাদের রপ্তানি ছিল ১৯ বিলিয়ন, ১৯.৯ বিলিয়ন আর এখন এই বছরে একই স্তরে আছে। তাই টাকা ডলারের বিপরীতে স্থিতিশীল হয়েছে। আমাদের রেমিট্যান্স বেড়েছে। সুতরাং অর্থনৈতিক পতনের অনুভূতি এখন দূর হয়েছে। বলতে পারেন, আমরা স্থিতিশীল অবস্থায় আছি।’

রাজ চেঙ্গাপ্পা বলেন, এবার আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আসি। তিনি জানতে চান, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম, যা যুব আন্দোলনের মধ্যে রূপ লাভ করেছে। গত মাসে ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, যারা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে একটি নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেছেন। এটি ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি বা এনসিপি নামে পরিচিত। আপনি জানেন যে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে দুটি পারিবারিক নেতৃত্বাধীন দল হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং খালেদার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে।’

তিনি আরও প্রশ্ন রাখেন, ‘এখন এনসিপি কিছু দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের দ্বিদলীয় রাজনীতির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে, যা কয়েক দশক পর প্রথমবারের মতো বড় ধরনের একটি পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। ঢাকায় একটি সমাবেশে এনসিপি নেতারা দ্বিতীয় একটি প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন এবং পুরনো ন্যারেটিভগুলো যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ইসলামপন্থী এবং ভারত বনাম পাকিস্তান সম্পর্কের থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। আবার, যা ঘটেছে তার একটি ধারণা দেওয়ার জন্য জুলাই আন্দোলনের ২৬ বছর বয়সী প্রতীক নাহিদ ইসলাম ইউনূস সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে এনসিপির আংশিক প্রধান বা কনভেনর হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। এই নতুন রাজনৈতিক দলের আগমন কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ কী?

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক দলের আগমন নিঃসন্দেহে এমন কিছু, যা আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব প্রত্যাশা করছি। কারণ যেমন আপনি বলেছেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে দ্বিদলীয় পরিস্থিতিতে ছিলাম— বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ। এটা সত্যিই পাঁচ বছরের নির্বাচনী সময়কালে দুলতে থাকত, যতক্ষণ না হাসিনা শেষ ১৫ বছর শাসন করলেন। তবে তার আগে ১৯৯১ সাল থেকে, যেটিকে আমরা ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ বলে জানি, যেটি জেনারেল আতাউর রহমানের পতনের বছর, তখন থেকে এই পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তা ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, এরশাদের জাতীয় পার্টি আছে, আছে জামায়াতে ইসলামী, যা বাংলাদেশের পুরনো দলগুলোর একটি। এখন বর্তমান অবস্থায়, ছাত্রদলের আগমন একটি নতুন উপাদান। একবার তারা একটি রাজনৈতিক দল গঠন হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে প্রবাহিত হতে হবে। নতুন দলের নেতারা হাসিনাকে অপসারণ করেছিল, তাই তাদের মধ্যে একধরনের সফলতার অনুভূতি রয়েছে, এমন কিছু যা বিএনপি করতে পারেনি, এমন কিছু যা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারেনি, তারা কয়েক মাসের আন্দোলনে এটি করেছে। সুতরাং সেই আত্মবিশ্বাস এখনো তাদের মধ্যে আছে। তাদের মনে হয় তারা বাংলাদেশকে সেভাবে রূপান্তরিত করতে পারে, যেভাবে তারা জিতেছিল। তারা রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে, বিশেষ করে নির্বাচনের ক্ষেত্রে। নির্বাচনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমরা সবাই এটি নিয়ে অধীর আগ্রহে আছি।

প্রথমত, এটা এখন মোটামুটি নির্ধারিত যে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর অথবা সর্বাধিক জানুয়ারি মাসে হবে নির্বাচন। তবে ছাত্র দলগুলো প্রকাশ্যে বলছে, তারা নির্বাচন অপেক্ষা বেশি সংস্কার চায়। কিন্তু তারা নতুন এবং নির্বাচনে যেতে কিছুটা ভীত। হয়তো তারা দেখবে জনগণের সমর্থন তেমন নেই।

অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করছে, কারণ আওয়ামী লীগ এখন একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুতরাং বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, ছাত্ররা তেমন আগ্রহী নয় এবং জামায়াতে ইসলামী, যারা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর, তারা দ্বিধাগ্রস্ত—তারা অপেক্ষা করতে রাজি, ১০-১৫ বছরও অপেক্ষা করতে রাজি। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে যদি হয়, কিন্তু স্থগিত হলেও তাদের তেমন সমস্যা নেই। এটাই এখন পরিস্থিতি।  

তবে মূল কথা হলো, দেশবাসী নির্বাচন চায়। হাসিনার সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, গত তিনটি নির্বাচনে—২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সবগুলোতে অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি। সুতরাং বর্তমানে বাংলাদেশে একটি প্রবল আগ্রহ রয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং ভোটাররা তাদের ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরে পেতে চান। এই পরিস্থিতি অনুযায়ী, আমরা ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন দেখতে যাচ্ছি, যদি তা কোনো নাটকীয় কারণে স্থগিত না হয়।

এরপর রাজ বলেন, আপনি দেখেছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা কীভাবে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছেন। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, নতুন এনসিপি দলটি ইসলামী উপাদানে আধিপত্য বিস্তার করছে এবং  জামায়াতে ইসলামী দলটি ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নিচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশ তার ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতিগুলো হারাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ইউনূস সরকার যে সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, তা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মতো শব্দগুলোকে মৌলিক মূলনীতি হিসেবে বাদ দিয়ে তাদের স্থলে প্রস্তাব করেছে সমতা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সম্ভবত বৈচিত্র্যের মতো বিষয়গুলো। সুতরাং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিগুলো কি বিপন্ন এবং এটি কি ইসলামী পথে চলে যাচ্ছে? অনেক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করছেন, যেমনটা আমরা পাকিস্তানে দেখেছি।

মাহফুজ উত্তর দেন, এটি ভারতীয় এবং বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ, ভারতীয় সাংবাদিক ও বাংলাদেশি সাংবাদিকদের জন্যও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছাত্ররা কিছু দাবি করেছে, সাংবিধানিক কমিশন এই সুপারিশগুলো করেছে। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এর বিরোধিতা করেছে এবং তারা খুব জোরালোভাবে বলেছে, তারা পুরনো অগ্রাধিকার ফিরিয়ে আনতে চায়, যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র। সুতরাং এখানে আপনি একটি পরিষ্কার পরিস্থিতি দেখছেন। যেখানে সবচেয়ে বড় দল এই পরিবর্তনগুলোর বিরোধিতা করছে এবং ছাত্ররা এর সমর্থনে দাঁড়িয়েছে, আর নির্বাচনই এটি নির্ধারণ করবে।

তিনি আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী দলটি অনেক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, তবে তারা কখনোই ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তারা একসময় ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সুতরাং এটি তাদের ঐতিহাসিক ভোটের সমর্থন। তারা হয়তো একটু বেশি, ১০ শতাংশ পর্যন্ত পেতে পারে, তবে আমি মনে করি এর বেশি হবে না।  

তবে বাংলাদেশের ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানের মতো হওয়ার ব্যাপারের বড় প্রশ্নে আমি বলব, আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং অন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করব, তারা বাংলাদেশকে আরও গভীরভাবে বিবেচনা করুক। আপনি জানেন, পাকিস্তান একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং তেমনি বাংলাদেশও একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আমি আপনাকে বলতে চাই, আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও, আমরা পাকিস্তান ভেঙেছি।

আমরা সেই জাতি, যারা বাংলাদেশে নিয়ে গর্বিত এবং আমরা মুসলিম হিসেবে গর্বিত। তবে মুসলিম হওয়া মানে এই নয় যে, আমরা ধর্মীয় মৌলবাদী। আমি আমার ভারতীয় বন্ধুদের অনুরোধ করব, আমাদের এই ফাঁদে ফেলবেন না, আমাদের পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করবেন না, আমাদের আলাদাভাবে ভাবুন।

এরপর রাজ আবার প্রশ্ন করেন, আমি আপনাকে নতুন সরকারের প্রথম কিছু মাসে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রসঙ্গে বলতে চাই, যে বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা এবং ভারত সরকারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি আরএসএস (ভারতের শাসক বিজেপি দলের আদর্শিক সংগঠন) বেঙ্গালুরুতে তাদের জাতীয় বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা করেছে। তারা এ বিষয়টিকে একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছে, যার মধ্যে পাকিস্তান এবং ডিপ স্টেটের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলছে, বর্তমান বাংলাদেশ প্রশাসন সমর্থিত মৌলবাদী ইসলামিক গ্রুপগুলো হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর এমন আক্রমণগুলো সংগঠিত করছে। এখন আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখেন?  

মাহফুজ আনাম উত্তর দেন, প্রথমে আমার অনুরোধ থাকবে, আমি বিষয়টি আরএসএসের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে দেখতে চাই, ভারতীয়দের নয়। কারণ যদি এটি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠে, তবে আমরা সত্যিই বড় সমস্যায় পড়ব। আরএসএস একটি অত্যন্ত গতিশীল আদর্শিক দল। যদি আপনি আমাদের জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তারাও একটি আদর্শিক দল। তাদের ভারতের প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা বাংলাদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলবে না।

তাই আমি এটিকে আরএসএসের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে দেখতে চাই। আর আমি আশা করি, ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিন এবং ভারতীয় অন্য স্কলাররা আমাদের আরও স্বাধীনভাবে দেখবে। এখানে কোনো ইসলামিক ষড়যন্ত্র নেই। ভারতের মধ্যে এমন কিছু গ্রুপও থাকতে পারে, যারা ভারতকে কিছুটা অন্যভাবে দেখতে চায়। তারা আদর্শিকভাবে ভারতকে আরও গভীরভাবে একটি হিন্দু দেশ হিসেবে দেখতে চাইবে। বাংলাদেশেও কিছু গোষ্ঠি আছে যারা একটি ইসলামিক বাংলাদেশ দেখতে চায়, কিন্তু আমরা ১৮০ মিলিয়ন মানুষ, আপনি ডিসেম্বর মাসে আমাদের নির্বাচনেই দেখবেন, কীভাবে অসাম্প্রদায়িক দলগুলোই অধিকাংশ ভোট পায়।

এরপর রাজ বলে ওঠেন আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, ভারতীয় সরকার হিন্দুদের নির্যাতনের ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছে, সেটা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

মাহফুজ আনাম বলেন, আমি মনে করি এটি আমাদের দুর্বলতা ছিল। এমন কিছু ঘটতে দেওয়া উচিত ছিল না। তবে এই সরকার তার দেখভাল করেছে এবং থামিয়েছে। প্রথম দুই-তিন মাসের ঘটনা বাদ দিলে, আপনি বাংলাদেশের সঠিক চিত্র দেখতে পাবেন। কিন্তু হ্যাঁ, সংখ্যালঘুদের নিয়ে সমস্যা ভারতেও ফিরে আসছে। আপনাদের সব প্রচেষ্টার পরেও হিন্দু-মুসলিম সমস্যা ফিরে এসেছে। এখন আমি এটাও বলতে পারি না যে আমরা এই অভিশাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পেয়েছি, আমরা সংগ্রাম করছি। দক্ষিণ এশীয় মহাদেশ সংগ্রাম করছে। ভারত সংগ্রাম করছে, আমরা সংগ্রাম করছি। আধুনিকীকরণের দৃষ্টিকোণে আমি মনে করি, আমাদের একে অপরকে সাহায্য করা উচিত এবং এগিয়ে যাওয়া উচিত। এটি আমার দৃষ্টিভঙ্গি। আমি বলব না যে, আমরা এটি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছি, কিন্তু আমরা এতটা নিষ্ঠুর সাম্প্রদায়িক দেশও নই।

রাজ জানতে চান, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রতিবন্ধকতা কী?

মাহফুজ বলেন, আমি মনে করি, ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে বারবার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক, বোঝাপড়া এবং গভীর সহযোগিতার প্রয়োজন। এটাই বাংলাদেশের সরকারের অবস্থান, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান। তিনি এই বিষয়টি বহুবার উল্লেখ করেছেন এবং আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে একটি বৈঠকের প্রস্তাবও দিয়েছি। তবে এটি সত্যি আপনি বাংলাদেশের রাস্তায় হাঁটলে সেখানে ভারতের প্রতি একটি শক্তিশালী বিরূপ মনোভাব দেখবেন। এই বিরূপ মনোভাব আমি বলব ভারতের বিরুদ্ধে নয়, বরং ভারতের দীর্ঘদিনের হাসিনার সমর্থনের বিরুদ্ধে।

আবারও বলব, যদি ভারত এবং হাসিনার সহযোগিতা থাকে, আমরা তা স্বাগত জানাই। তবে হাসিনা দিনে দিনে আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছিলেন। হাসিনা আসলে গণতান্ত্রিক সমাজ এবং নির্বাচন সম্পর্কে মৌলিক ধারণাগুলো ভুলে গিয়েছিলেন। এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এই সব ক্ষেত্রে ভারত তার সঙ্গী ছিল। কারণ হাসিনা ভারতের পন্থা অনুসরণ করতেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটি পরিবর্তনে সময়, এই মনোভাবটি কমবে এবং নির্বাচন আসার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি আরও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফিরে আসবে। সরকার অবশ্যই ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী এবং আমরা আশা করি, জয়শঙ্কর আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত এবং সম্মানিত একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি অবশ্যই আরেও ভালো দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন। সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই ভারতকে সব কিছুর জন্য দোষারোপ করা হয়নি, হয়তো কিছু মতামত বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এসব বলছেন, তবে সরকার এই ধরনের বক্তব্য দেয়নি।

Read Entire Article