বিএনপিপন্থি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের ‘কমিটি বিতর্ক’, অভিযোগ বঞ্চিতদের

2 days ago 5

বিএনপিপন্থি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সংগঠন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিইএব)-এর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পরই এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন পদবঞ্চিতরা। একের পর এক উঠছে অভিযোগ।

সেসব অভিযোগে বলা হচ্ছে, কমিটিতে বিতর্কিতদের জায়গা দেওয়া হয়েছে। এমন লোকদের আনা হয়েছে—জুলাই অভ্যুত্থানের আগে সংগঠনে যাদের কোনো সক্রিয়তা ছিল না। এমনকি পদ পাওয়া অনেকে অতীতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন।

শনিবার (৩০ আগস্ট) রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ৩৩ সদস্যের ঘোষিত কমিটিতে আহ্বায়ক মো. হানিফ ও সদস্যসচিব করা হয় কাজী সাখাওয়াত হোসেনকে।

কমিটির আহ্বায়ক মো. হানিফ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একটি কলেজে ছাত্রশিবিরের সভাপতিও ছিলেন। আবার ৩৩ সদস্যের এ আহ্বায়ক কমিটির অন্তত ২৭ জন জুলাই অভ্যুত্থানের আগে সংগঠনে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। মাঠপর্যায়ে তাদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় নেই।- অভিযোগ পদবঞ্চিতদের

এরপর খোদ আহ্বায়ককে নিয়েই অভিযোগ তোলেন পদবঞ্চিতরা। তাদের অভিযোগ, মো. হানিফ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। এমনকি তিনি একটি কলেজে ছাত্রশিবিরের সভাপতিও ছিলেন।

কমিটি ঘোষণার পর গঠিত কমিটি ও সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম-জালিয়াতির অভিযোগ উঠছে। যদিও নেতৃত্বসহ সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ আকারে গত ৩ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জানিয়েছিলেন ডিইএব সদস্যরা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের এসব অভিযোগ আমলে নেয়নি বিএনপি। এমনকি অভিযোগকারী বা তাদের অনুসারীদের আহ্বায়ক কমিটিতেই রাখা হয়নি।

পেশাজীবীরা হলো সুবিধাভোগী শ্রেণির। তারা যখন সুবিধা দেখে, ঝাঁপায় পড়ে। আবার বিপদ দেখলে পিছপা হয়। আবার যারা বুদ্ধিমান, তারা কচ্ছপের মতো। একবার মাথা বের করে, আবার ভেতরে ঢুকে যায়। এমন কচ্ছপ স্বভাবী কিছু লোক কমিটিতে আছে।- আহ্বায়ক মো. হানিফ

পদবঞ্চিতদের অভিযোগ, ডিইএব ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সংগঠন। অথচ এ কমিটির আহ্বায়ক মো. হানিফ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একটি কলেজে ছাত্রশিবিরের সভাপতিও ছিলেন। আবার ৩৩ সদস্যের এ আহ্বায়ক কমিটির অন্তত ২৭ জন জুলাই অভ্যুত্থানের আগে সংগঠনে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। মাঠপর্যায়ে তাদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় নেই।

তারা বলছেন, কমিটির অনেক নেতা নতুন, ফলে তারা এ কমিটি সম্পর্কে অবগতই নন। আবার যারা যোগ্য ছিলেন, তাদের আহ্বায়ক কমিটিতে রাখা হয়নি। উল্টো অতীতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন—এমন ব্যক্তিরা আহ্বায়ক কমিটিতে পদ পেয়েছেন।

আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব ছাড়াও গঠিত ওই কমিটিতে আটজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ২৩ জনকে সদস্য করা হয়েছে। তবে কমিটি ঘোষণার পরই বিএনপিপন্থি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও ডিইএবের বিগত কমিটির নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

এ কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এমন লোকদের কমিটিতে রাখা হয়েছে, যাদের অধিকাংশকে আগে কখনো দেখিনি।- ডিইএব খুলনার সাধারণ সম্পাদক শাহিন মিয়া

সংগঠনটির পদবঞ্চিত নেতারা জানান, প্রকৌশলী মো. হানিফ সংগঠনের প্রাক্তন সদস্য হলেও ‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য’ তৃণমূলে তিনি এখনো যথেষ্ট বিতর্কিত। এছাড়া মো. হানিফ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৮০ সালে ছাত্রশিবির থেকে ভিপি নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে বর্তমান ডিইএবের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি প্রকৌশলী ইবনে ফজল সাইফুজ্জামান জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সরাসরি ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিইএব আহ্বায়ক মো. হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘৪৫ আগে বিএনপিরও জন্ম হয়নি। ফলে এর আগে কে কী করছে তা এখন দেখার বিষয় না। আমি ৮২ সাল (১৯৮২) থেকে বিএনপি করছি।’

অন্যদিকে, কমিটির সদস্যসচিব কাজী সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)-এর সদস্যসচিব হওয়ার পর সংস্থাটিতে ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষত, বিভিন্ন জেলা কমিটি গঠনে বাণিজ্যে জড়ান। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক মামলা প্রক্রিয়াধীন, বলছেন অভিযোগকারীরা।

৩৩ সদস্যের ঘোষিত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন মো. আবেদুর রহমান। অভিযোগ উঠেছে, তিনি গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত শিল্পগোষ্ঠী সামিট গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েছেন। তিনি বর্তমানেও ওই শিল্প গ্রুপটির একজন জিএম (জেনারেল ম্যানেজার) হিসেবে কর্মরত।

আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সৈয়দ রাশেদুল হাসান রেজা বিগত সরকারের আমলে দীর্ঘ ১৫ বছর ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির মালিকানাধীন একটির কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং বর্তমানেও এ পদে বহাল আছেন। অন্য সদস্য শাহাদাত হোসেন সবুজ সামিট গ্রুপের বিভিন্ন প্রকল্পের সাইট ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

পদবঞ্চিতরা বলছেন, অথচ রুহুল কবির রিজভীর সই করা ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আহ্বায়ক কমিটিকে বলা হয়েছে, পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে ছবি, ভিডিও বা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এমন ব্যক্তিদের ডিইএব সদস্য করা যাবে না।

আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানা স্বপন, সদস্য আসাদুজ্জামান, হুমায়ুন কবির শামিম, গাজী মো. সেলিম, আশরাফুল হোসেন শাকিল, কাজী মো. ইলিয়াস, শফিউল আজম সোহেল, মিজানুজ্জামান রুবেল—পদ পাওয়া এই নেতারা অতীতে ডিইএবে সক্রিয় ছিল না বলেও অভিযোগ আছে।

কমিটির ৩১ নম্বর সদস্য কাজী মো. ইলিয়াছ। শনিবার (৩০ আগস্ট) রাতে তিনি নিজের ফেসবুক পেজে এক স্টাটাসে লিখেছেন, ‘তিনি কমিটি সম্পর্কে অবগত নন। এ বিষয়ে তাকে নিয়ে কেউ যেন ফেসবুকে পোস্ট না করে।’

ডিইএব ঢাকা জেলার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মেহেরাব। তিনিও ঘোষিত কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘৩৩ সদস্যের নতুন কমিটির অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলে রাজপথের আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ছিল। তাদের জেল-জুলুম হামলা-মামলা কিছুই হয়নি। বরং তারা সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিল।’

ডিইএব খুলনার সাধারণ সম্পাদক শাহিন মিয়া ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এমন লোকদের কমিটিতে রাখা হয়েছে, যাদের অধিকাংশকে আগে কখনো দেখিনি।’

আপনার কমিটিতে যারা আছেন, তারা সবাই বিগত বছরগুলোতে সক্রিয় ছিলেন কি না—এমন প্রশ্নে ডিইএবের নতুন কমিটির আহ্বায়ক মো. হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজপথে যখন আন্দোলন-সংগ্রাম হয়, তখন পেশাজীবীরা সংখ্যায় কম থাকে। কারণ, যেকোনো পেশাজীবীরা হলো সুবিধাভোগী শ্রেণির। তারা যখন সুবিধা দেখে, ঝাঁপায় পড়ে। আবার বিপদ দেখলে পিছপা হয়।’

‘আবার যারা বুদ্ধিমান, তারা কচ্ছপের মতো। একবার মাথা বের করে, আবার ভেতরে ঢুকে যায়। এমন কচ্ছপ স্বভাবী কিছু লোক কমিটিতে আছে। অথচ রাজপথে আন্দোলনের সময় আমাদের ব্যানার ধরার লোক ছিল না।’

সুবিধাবাদীরা কীভাবে কমিটিতে জায়গা পেলেন—জানতে চাইলে ডিইএব আহ্বায়ক বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমাদের কমিটি গঠনে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন। আমরা দুটি প্যানেল থেকে তার কাছে নাম দিয়েছি। তারা যাচাই-বাছাই করে আহ্বায়ক কমিটির তালিকা তৈরি করেছে। এখানে যোগ্যদেরই রাখা হয়েছে।’

ডিইএব কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি (রাজশাহী বিভাগ) তৈয়ব আলী মুকুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত ১৬ বছর আমরা দলের আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলাম, কিন্তু আমাকেও কমিটিতে রাখা হয়নি। এটি একটি পকেট কমিটি হয়েছে। এখানে ছাত্রদল, যুবদল, কৃষকদল করা লোকজনও পদ পাননি। আবার অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিকেও কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।’

এমএমএ/এমকেআর/জিকেএস

Read Entire Article