ঢাকার ২০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আসন ঢাকা-৭। বুড়িগঙ্গা তীরের নবাবি ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল এ অঞ্চল। লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, বংশাল, কোতোয়ালির কিছু অংশ নিয়ে গঠিত (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৩-৩৩ ও ৩৫-৩৬-এর আংশিক অঞ্চল) আসনটি এখনো ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে।
লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিলের মতো প্রাচীন স্থাপত্য, ঐতিহাসিক স্থান ও পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ ব্যবসায়িক এ এলাকায় আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল বাজছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন নির্বাচনি প্রচারণায়। বিলবোর্ড, ফেস্টুন, পোস্টারে ঢেকেছে পুরো এলাকা। মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা।
এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্তত ছয়জন। এর মধ্যে আছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-যুব বিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম রাসেল ও যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার। মাঠে আছেন আরও দুজন। তবে বিএনপির সঙ্গে জোট হলে আসনটি খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা মামুনুল হককে ছেড়ে দিতে পারে বলেও গুঞ্জন আছে। সবমিলিয়ে এ আসনে কিছুটা বেকায়দায় বিএনপি।
জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে মাঠঘাট চষে বেড়াচ্ছেন হাজি এনায়েত উল্লাহ। আসনটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও দিয়েছে একক প্রার্থী। দলটির কেন্দ্রীয় কৃষি ও শ্রম বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রহমান এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সেদিক থেকে বিএনপির চেয়ে বেশ নির্ভার জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। এনসিপির পক্ষ থেকে কে নির্বাচন করতে পারেন সেটা জানা যায়নি। তাদের প্রচারণা চোখে পড়েনি।
আসনটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান প্রায় সমানে সমানে। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সহজ জয় পান। ১৯৭৯ সালে জয়ের দেখা পান বিএনপির প্রার্থী। আশির দশকে সামরিক শাসনের সময় (১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে) এ আসনে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি কিছুটা শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। ১৯৯১ সালে এ আসনে শেখ হাসিনাকে হারিয়ে জয়ী হন বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা। ২০০১ সালেও আসনটি ছিল খোকার কব্জায়। ২০০৮ সাল থেকে আসনটি আবার আওয়ামী লীগের দখলে যায়। হাজী সেলিম ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও ২০১৮ সালে আবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হন। সবশেষ ২০২৪ সালে ছেলে হাজী সোলায়মান জয়লাভ করেন।
এবার আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩৬। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৮১ হাজার ১৭০ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ৭৬৫। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার একজন।
আরও পড়ুন
নারায়ণগঞ্জ-৪/পলাতক শামীম ওসমানের আসনে আলোচনায় যারা
ঢাকা-৫ আসন/বিএনপিতে সালাহউদ্দিন-নবী-নয়ন, জুলাই স্পিরিট নিয়ে মাঠে জামায়াত
নারায়ণগঞ্জ-৩/হারানো আসন ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি, মাঠে আছে জামায়াত-এনসিপি
ধানের শীষ-দাঁড়িপাল্লা-লাঙ্গল যেভাবে প্রতীক হয়ে উঠলো
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার সীমানা পরিবর্তন হওয়ায় ভোটার ও প্রার্থীর ক্ষেত্রে কিছুটা অদল-বদল হয়েছে। আওয়ামী লীগের অবস্থান এ আসনে বেশ শক্ত ছিল। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দল হিসেবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ এখন পর্যন্ত নেই। বিএনপি চাইবে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। জামায়াতও তাদের শক্তি দেখাতে প্রস্তুত। একক প্রার্থী ঘোষণা করে চাঙা আছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন।
বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক
এই আসনে ধানের শীষ মার্কা পেতে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-যুব বিষয়ক সম্পাদক। এর আগে তিনি যুবদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত তিনি।
দলের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী এই নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্বৈরাচার হাসিনা আমাদের নানাভাবে নির্যাতন করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাকে যদি দল প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয় তাহলে এ অঞ্চলে আমি সর্বোচ্চ স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করবো। একটি নিরাপদ এলাকা গড়ে তুলতে কাজ করবো। নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে ৩১ দফা, সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকবে।’
প্রার্থী হতে চান বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা। তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় না হলেও স্বামীর প্রভাবের কারণে এ এলাকায় বেশ জনপ্রিয়।
ধানের শীষের কাণ্ডারি হতে চান রফিকুল ইসলাম রাসেলও। তিনি বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, পাঠাগার সম্পাদক ও সহ-সভাপতি ছিলেন। মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
রফিকুল বলেন, ‘শেখ হাসিনা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিল। আমি মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাই। পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীদের বসবাস অনেক, তাদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে সন্ত্রাসমুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত পুরান ঢাকা বিনির্মাণে কাজ করবো। পুরান ঢাকায় ঢোকার রাস্তা তথা নাজিমুদ্দিন রোড প্রশস্ত করলে ব্যবসাসহ অনেক কিছু সহজ হবে। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করে আধুনিকায়ন করার কাজ করবো।’
এ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হতে চান যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারও। তিনি একসময় ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘদিন কারানির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। মিটফোর্ডে একজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় নাম জড়িয়ে তিনি কিছুটা ব্যাকফুটে আছেন।
মনোনয়ন দৌড়ে আরও আছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মোশাররফ হোসেন খোকন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হামিদুর রহমান হামিদ। তারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে এ আসনে সরাসরি বিএনপি থেকে প্রার্থী না দিয়ে জোট থেকেও দেওয়ার একটা জোর আলোচনা আছে। সেক্ষেত্রে খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মামুনুল হক এ আসনে জোটের প্রার্থী হতে পারেন।
জামায়াত-ইসলামী আন্দোলনের একক প্রার্থী
জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন হাজি এনায়েত উল্লাহ। তিনি অনেকটা নির্ভার হয়েই প্রচারণা চালাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এবং ঢাকা-৭ আসনে ঢাকার স্থানীয় ভোটার সংখ্যা বেশি হওয়ায় তিনি আশা করছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হবেন। যদিও তার বিরুদ্ধে আগে আওয়ামী লীগের হাজী সেলিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে।
দলের উচ্চতর পর্যায়ের নেতা না হয়েও মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিটি পার্টিতে পলিসি ইরোর ট্রায়াল রয়েছে। সেই পলিসি অ্যাডাপ্টের চেষ্টা করা হয়। না হলে পরিবর্তন হয়। আমাদের টার্গেট যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ লোক। যারা দুর্নীতি ছাড়া মানুষের আমানত রক্ষা করবে। সেক্ষেত্রে রুকন বা কর্মী দেখা হবে না। এনায়েত সাহেবের যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছে।’
আসনটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও দিয়েছে একক প্রার্থী। দলটির কেন্দ্রীয় কৃষি ও শ্রম বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রহমান এ আসনের প্রার্থী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাকে পীর সাহেব চরমোনাই ঢাকা-৭ আসনের জন্য মনোনীত করেছেন। আমি মানুষের খাদেম হতে চাই।’
ভোটাররা চান স্থানীয় নেতা-নির্বিঘ্নে ব্যবসার নিশ্চয়তা
ঢাকা-৭ আসনের ভোটাররা অন্য এলাকার ভোটার থেকে কিছুটা ভিন্ন। তারা দল দেখে নয়, পুরান ঢাকার স্থানীয় নন এমন কাউকে তারা ভোট দিতে রাজি নন।
চকবাজারের অধিবাসী রমিজ মাতুব্বর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদেরই নির্বাচিত করবো। বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এমন কাউকে আমাদের ভোট দেওয়া সম্ভব না।’
বুড়িগঙ্গা নদী তীরবর্তী হওয়ায় নৌ-পথ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এটি। দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি ও খুচরা বিপণন কেন্দ্র। যেখানে চকবাজার, ইসলামপুর, বংশাল ও ইংলিশ রোডের মতো বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র রয়েছে। এখানে কাপড়, ওষুধ, ইলেকট্রনিকস ও খাদ্যপণ্যের বৃহৎ বাজার ছাড়াও হাজারীবাগের পুরোনো ট্যানারি শিল্প ছিল দেশের চামড়া রপ্তানির অন্যতম ভিত্তি। সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করতে পারা তাই এলাকার মানুষের অন্যতম অগ্রাধিকার।
লালবাগের ব্যবসায়ী সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এ এলাকাটা সাধারণত ব্যবসাপ্রধান এলাকা। এখানে ছোট-বড় অসংখ্য ব্যবসা আছে। যারা এই ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারবে আমার মনে হয় তারাই এখানে বিজয়ী হবে। দল কোনো বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না।’
সুপ্রদীপ সাহা নামে আরেক ভোটার বলেন, ‘অল্প একটু বৃষ্টি হলেই পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় বাজেভাবে পানি জমে থাকে। রাস্তা সরু হওয়ায় চলাচল করাও যায় না। এর আগে অনেকেই এ সমস্যা সমাধানের কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমরা এমন একজন জনপ্রতিনিধি এ আসনের জন্য চাই যিনি এসব সমস্যা নিজের সমস্যা হিসেবে মনে করবেন এবং তা সমাধানে কাজ করবেন।’
এমএইচএ/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস

12 hours ago
5









English (US) ·