৬ অক্টোবর, রাত ৯টা। উত্তর ত্রিপুরার কদমতলা বাজারে নিজের স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানে বসেছিলেন আলফেশানি আহমেদ। এমন সময় হঠাৎ বাজারে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে তিনি দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে যান।
আলফেশানির ভাই শাহিন আহমেদ (৩৮) জানান, ওই সময় বাজারে তাণ্ডব চালাচ্ছিল একদল হিন্দু। ইসলাম ধর্মানুসারী আলফেশানি বুঝতে পেরেছিলেন, তার দোকানেও হামলা অবধারিত। এ কারণে দ্রুত কেবল হিসাবের খাতাটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যান ৩৬ বছর বয়সী এ যুবক।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সংঘর্ষ
ঘটনার দিন সকালে একজন মুসলিম গাড়িচালক দুর্গাপূজার চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে স্থানীয় হিন্দু ক্লাবের সদস্যরা তাকে এবং তার গাড়িতে থাকা আরেক মুসলিম যাত্রীকে মারধর করে। এর ফলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়।
একপর্যায়ে কদমতলা বাজারে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি সামালতে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বেশ কয়েকজন আহত এবং একজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তি ছিলেন আলফেশানি আহমেদ। তার কপালে গুলি লেগেছিল।
আরও পড়ুন>>
- বাংলাদেশি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন ত্রিপুরার হোটেল মালিকরা
- বাংলাদেশি রোগী বয়কটের বিরোধিতা করলো ভারতীয় চিকিৎসক সংগঠন
- হোটেল-রেস্তোরাঁয় গরুর মাংস নিষিদ্ধ করলো আসাম, বিরোধীদের ক্ষোভ
পুলিশ দাবি করেছে, তারা কাউকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়নি। তবে আলফেশানির পরিবার ঘটনাটিকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে দাবি করেছে।
মুসলিমদের ওপর আক্রমণ
৭ অক্টোবর কদমতলা বাজারে মুসলিম মালিকানাধীন দোকান ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কদমতলা জামে মসজিদেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে বহু ধর্মীয় বইপত্র পুড়ে যায়।
ওইদিন মুসলিম ব্যবসায়ী সুহেল আহমেদ খানের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তিনি বলেন, এটি একটা সম্মিলিত শাস্তি। আমাদের মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
স্থানীয় কংগ্রেস নেতা হীরা লাল নাথ দাবি করেন, এই হামলার পেছনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল জড়িত ছিল।
ত্রিপুরার সাম্প্রদায়িক বাস্তবতা
ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী সম্প্রদায় এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এসেছে। তবে, ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের ইতিহাস ছিল না।
কিন্তু, ২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ত্রিপুরায় মাত্র দুটি সম্প্রদায়গত সংঘর্ষের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, যা ২০১৯ সালে ঘটে।
আরও পড়ুন>>
- সীমান্ত বন্ধ হলে বড় ক্ষতি ভারতের, ঝুঁকিতে লাখো মানুষের জীবিকা
- বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক, বলছেন ফেরত যাওয়া ভারতীয় ট্রাকচালকরা
- করিমগঞ্জ জেলার নাম বদলে শ্রীভূমি রাখলো আসাম সরকার
কিন্তু, ২০১৮ সাল থেকে হিন্দু সংগঠনগুলোর সম্প্রদায়গত উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াসে এসব ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর আইনপ্রণেতা উদ্দিন।
এই ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মুসলিম মালিকানাধীন রাবার বাগানে ডানপন্থি সংগঠনগুলোর হামলা এবং একটি প্রাচীন মসজিদকে মন্দির বলে দাবি করা। মুসলিম পুরুষদের ওপর হিন্দুদের গণপ্রহারের ঘটনাও বেড়েছে।
বিজেপির ত্রিপুরা শাখার মুখপাত্র সুব্রত চক্রবর্তী দাবি করেছেন, বর্তমান সরকার কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয় না। এটি একটি সক্রিয় এবং উন্নয়নমুখী সরকার।
তবে, বাস্তবতা হলো- কদমতলা এলাকায় এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ব্যবসায়ী সুহেল আহমেদ খান বলেন, এখানে বাজারের ৭০ শতাংশ ক্রেতা মুসলিম। কিন্তু তারা এখন কোনো হিন্দুর দোকান থেকে কিছু কিনতে চান না। আগে যে সম্প্রীতি ছিল, তা ফিরে আসতে অনেক বছর লেগে যাবে, হয়তো আর কোনোদিন না-ও ফিরতে পারে।
কদমতলা বিজেপির সংখ্যালঘু শাখার সাবেক সদস্য আব্দুল হকের মতে, সাম্প্রতিক সহিংসতা একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের প্রতীক। তিনি বলেন, আগে হিন্দু উৎসব চলাকালীন মাইক এমনভাবে লাগানো হতো যাতে মুসলিমদের অসুবিধা না হয়। এখন তারা মাইক চালিয়ে উসকানিমূলক গান বাজায়।
‘ত্রিপুরার হিন্দুরা বদলে গেছে,’ মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্র: আল-জাজিরা
কেএএ/