বিদেশে উচ্চশিক্ষায় কভার লেটারেরর গুরুত্ব

5 hours ago 7

বিদেশে উচ্চশিক্ষার আবেদন প্রক্রিয়ায় কভার লেটার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল একটি চিঠি নয় বরং আপনার অভিজ্ঞতা, আগ্রহ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সংক্ষিপ্ত পরিচয়পত্র। সিভির বাইরে আপনি কে, কেন আপনি সেই প্রতিষ্ঠান বা প্রোগ্রামের জন্য উপযুক্ত—সেসব বিষয় কভার লেটারে ফুটে ওঠে। অনেক সময় একই যোগ্যতার একাধিক প্রার্থী থাকলে কভার লেটারই হয়ে ওঠে নির্বাচনের অন্যতম ভিত্তি। তাই এটি তৈরি করতে হয় সচেতনভাবে এবং গুরুত্ব সহকারে। কভার লেটার লেখার প্রয়োজনীয়তা, প্রোফাইলকে শক্তিশালী করে তোলা এবং লেখার সময় কী কী বিষয় খেয়াল রাখা উচিত—এসব বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী সোহীনি নদী। লিখেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

কভার লেটার: আত্মপরিচয়ের গল্প

আমার নিজের পড়াশোনার পথটা কখনোই খুব সোজা ছিল না। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রে এসে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা, আর নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়া—সবকিছুই একটা দীর্ঘ ও শিক্ষণীয় যাত্রা। এই পুরো সময়টার মধ্যে একটা জিনিস আমি স্পষ্টভাবে বুঝেছি; কভার লেটার শুধু একটা আবেদন নয়—এটা আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। যখন প্রথমবার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি, তখন সবার মতো আমিও শুধু সিভি আর ট্রান্সক্রিপ্টে ফোকাস করেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝেছি—সেখানে সবাই ভালো নম্বর পায়, সবাই কিছু না কিছু করে। পার্থক্যটা তৈরি হয় তুমি কে, কেন এই পথে হাঁটছো, আর ভবিষ্যতে কী করতে চাও—সেটা কতটা আন্তরিকভাবে প্রকাশ করতে পারছো। এই বিষয়গুলো কভার লেটারে ফুটিয়ে তোলা যায়।

নিজের গল্প দিয়ে শুরু

একটা কভার লেটারের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হলো তোমার নিজস্ব গল্প। আমি নিজের লেখায় শুরুতে লিখেছিলাম কেন আমি বিজনেস না নিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স মেজর নিয়েছি। কীভাবে আমার বাবার ৪০ বছরের পুরোনো পোশাক ব্যবসা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আর আমি সেটাকে ভবিষ্যতে টেকনোলজির মাধ্যমে বিশ্বমুখী করতে চাই—এই বাস্তব গল্পটাই আমাকে ‘আলাদা’ করে তুলেছিল। কারণ এটা কোনো বানানো কথা নয় বরং আমার জীবনের বাস্তব যাত্রা। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। কিন্তু দুর্বলতাকে স্বীকার করা মানেই হেরে যাওয়া নয়—বরং সেটাকে চেনা, বোঝা এবং ধীরে ধীরে শক্তিতে রূপান্তর করার প্রথম ধাপ। আমাদের সবার মাঝেই কিছু ‘দুর্বল জায়গা’ থাকে কিন্তু সেই দুর্বলতাকে জয় করার চেষ্টা—সেটাই আমাদের আলাদা করে তোলে। তুমি যদি নিজের চেষ্টায় সেই জায়গাগুলোয় কাজ করো, একসময় দেখবে—যে জায়গায় একসময় ভয় লাগতো, সেটাই এখন তোমার শক্তির উৎস।

একাডেমিক গল্প মানবিকভাবে বলা

নম্বর বা কোর্স লেখার পাশাপাশি লিখবে, কীভাবে পড়াশোনার সময় কোনো বিশেষ প্রজেক্ট বা কোর্স তোমার চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনেছে। আমি লিখেছিলাম—ম্যানেজেরিয়াল অ্যাকাউন্টিং আর মার্কেটিং রিসার্চ কোর্স আমাকে ডেটা অ্যানালিটিক্সের প্রতি আগ্রহী করেছে। যদি তুমি কোনো বিষয়ে দুর্বল হও যেমন- কোডিং, প্রেজেন্টেশন বা ইংরেজি কমিউনিকেশন—তাহলে সেটা লুকানোর দরকার নেই। বরং বলো, কীভাবে তুমি সেটার উন্নতির জন্য কাজ করছো। আমি শুরুতে আশাবাদী ছিলাম না, কিন্তু আমি ধীরে ধীরে প্র্যাকটিস, প্রজেক্ট আর মেন্টরের সাহায্যে উন্নতি করছি। এভাবে দেখবে তুমি শেখার মানসিকতা রাখো—যা একজন ছাত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ পেতে চান, রইলো ফয়সালের পরামর্শ 
বিদেশে পড়তে যাওয়ার পর যেসব বিষয় জানা জরুরি 

কেন এই প্রতিষ্ঠান

অনেকে শুধু লেখে ‘ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বা লন্ডন ইজ রেপুটেড...’—এটি খুব সাধারণ। বরং লেখো—কেন তুমি ওই প্রতিষ্ঠানে পড়তে চাও, কীভাবে সেটা তোমার লক্ষ্যকে সমর্থন করে। আমি নিজের কভার লেটারে লিখেছিলাম, আমি কেন লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি কলেজ বেছে নিয়েছি। কারণ এখানে প্র্যাকটিক্যাল প্রজেক্ট, হ্যান্ডস-অন লার্নিং আর বৈচিত্র্যময় স্টুডেন্ট কমিউনিটি আছে, যা আমাকে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দেবে। যদি তুমি মনে করো, এই প্রতিষ্ঠানে তোমার কিছু স্কিলের ঘাটতি আছে—তাহলে সেটা নিয়ে ভয় পেও না। বরং লিখো, তুমি কীভাবে সেই ঘাটতি পূরণ করবে। নতুন ক্লাবে যোগ দেওয়া, প্রজেক্টে কাজ করা বা অধ্যাপকদের গাইডেন্স নেওয়া। এভাবে তুমি প্রমাণ করতে পারবে—তুমি শুধু স্বপ্নবান নও, প্রস্তুতও আছো নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে লেখা

তুমি ভবিষ্যতে কী হতে চাও—এ অংশটা শুধু ‘অ্যামবিশন’ নয়, ‘ডিরেকশন’ দেখায়। আমি লিখেছিলাম—‘আমি চাই আমার দেশের ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডিক্রাফট ব্যবসাকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দিতে।’ তোমার লক্ষ্য যদি বড় হয়, সেটাকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে লেখা—কীভাবে তুমি ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নে পৌঁছাতে চাও। যদি মাঝপথে কোনো স্কিলের ঘাটতি থাকে, তা স্বীকার করে লেখা: ‘আমি জানি কিছু টেকনিক্যাল দিক এখনো শেখা বাকি, কিন্তু আমি কোর্স আর রিসার্চ প্রজেক্টের মাধ্যমে সেটা পূরণ করবো।’ এতে বোঝা যাবে, তোমার স্বপ্ন শুধু ভাবনা নয়—এটা এক বাস্তব পরিকল্পনা, যেখানে চেষ্টা আর ধৈর্যই তোমার সঙ্গী।

ভাষার সরলতা, ভাবের গভীরতা

অনেকে জটিল শব্দে লেখে, কিন্তু কভার লেটারের আসল শক্তি থাকে সত্যিকারের কথায়। সহজভাবে কিন্তু আন্তরিকভাবে লেখা। যেমন- ‘আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কেবল একটি ডিগ্রি পাওয়ার বিষয় নয়। এটি নিজের উদ্দেশ্যকে প্রভাবে রূপান্তরিত করার বিষয়।’ যদি ইংরেজি তোমার প্রথম ভাষা না হয়, সেটা সমস্যা নয়। বরং বলো, ‘যদিও ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়। আমি উপস্থাপনা এবং যোগাযোগের কাজের মাধ্যমে ক্রমাগত অনুশীলন করছি।’ এতে বোঝা যাবে, তুমি নিজের সীমাবদ্ধতা জানো, কিন্তু থেমে নেই—নিরন্তর চেষ্টা করছো নিজেকে আরও ভালো করতে। ভাষার সরলতা কখনো দুর্বলতা নয় বরং সেটাই তোমার চিন্তার গভীরতার পরিচয় দেয়। একটা কভার লেটারের শক্তি শব্দে নয়—তার অনুভবে। তুমি যদি হৃদয় থেকে লেখো, তোমার প্রতিটি লাইন পাঠকের মনে ছাপ ফেলবে। ভাষা দিয়ে ইমপ্রেস না করে, কানেক্ট করার চেষ্টা করো। যখন পাঠক তোমার কথায় তোমাকে ‘অনুভব’ করবে, তখনই তুমি সফল। আর মনে রাখবে—‘সরলতাই হলো পরিপক্বতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।’ তুমি যত বেশি নিজের ভাষায় সত্য থাকবে, তত বেশি তোমার কভার লেটার রিয়েল ও ইম্প্যাক্টফুল হবে।

নিজের ব্যক্তিত্ব দেখাও

তুমি কেমন মানুষ, তোমার মূল্যবোধ কী, আর কীভাবে তুমি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করো—এসবও প্রকাশ করো। আমি নিজের কভার লেটারে লিখেছিলাম, আমার বাবার অসুস্থতার সময়েও কীভাবে আমি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলাম। এটা শুধু দুঃখের গল্প নয়—এটা আমার সহনশীলতা অর্থাৎ বিপর্যয়ের মধ্যেও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেখিয়েছে। জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জই তোমাকে কিছু শেখায়। তুমি যদি সেখান থেকে শেখার চেষ্টা করো, তবে সেই কষ্টই একসময় তোমার আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে। দুর্বল মুহূর্তে ভেঙে না পড়ে শেখার চেষ্টা করাটাই তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি। নিজের ব্যক্তিত্ব মানে শুধু অর্জন নয়—তুমি কেমনভাবে মানুষ হও সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article