বিধি সংশোধনের ‘ফাঁদে’ চূড়ান্ত ফল, অনিশ্চয়তায় ১৬৯০ ক্যাডার

2 days ago 4

দীর্ঘ তিন বছর সাত মাস পর গত ৩০ জুন ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। এতে ১ হাজার ৬৯০ জন প্রার্থীকে ক্যাডার পদে নিয়োগে সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বিপত্তি বাধে রিপিট ক্যাডার (আগের বিসিএসেও একই ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত) ইস্যুতে। প্রায় চারশ জন প্রার্থীকে এমন ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হয়, যে পদে তিনি বর্তমানেও কর্মরত। ফলে তারা নতুন করে যোগ দিতে চান না। এতে পদগুলো শূন্য থেকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

কিন্তু প্রায় চার বছর ধরে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার পর বিসিএসে পদ শূন্য রাখা হচ্ছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে পিএসসি। বিতর্ক এড়াতে বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যাতে রিপিট ক্যাডারের জায়গায় মেধাক্রম অনুযায়ী নন-ক্যাডারের প্রার্থীদের সুপারিশ করা সম্ভব হয়।

পিএসসি বিধি সংশোধন করে আড়াইমাসেও পুনরায় ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করতে পারেনি। ফলে তাদের নিয়োগ দিয়ে গেজেটও প্রকাশ করতে পারছে না সরকার। এতে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের। বিধি সংশোধনের ‘ফাঁদে’ আটকা প্রার্থীরা এখন দ্রুত পুনরায় ফল প্রকাশের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন।

সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীরা বলছেন, চূড়ান্ত ফল প্রকাশের দুই মাস ১৮ দিন পার হলেও গেজেট প্রকাশসহ পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করেনি সরকার। পুনরায় ফল প্রকাশে বিধি সংশোধনের জন্য ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল আটকে রাখা হয়েছে। পিএসসি ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯তম বিসিএসে সক্রিয় থাকলেও ৪৪তম বিসিএস নিয়ে জটিলতা নিরসনে তৎপর নয়। এতে স্পষ্টত তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কর্মজীবনেও পিছিয়ে পড়ছেন।

বিধি সংশোধন হলেও পিএসসিতে আটকা ‘ফাইল’

রিপিট ক্যাডার ও লোয়ার ক্যাডার (একই বিসিএসে আগে নিয়োগ এবং এবারের চেয়ে আগে ভালো ক্যাডারে থাকা) পদে সুপারিশ ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে বিধি সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। গত ৯ জুলাই পিএসসি বিধি সংশোধনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তাতে অনুমোদন দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করে। এরপর সচিব কমিটি হয়ে তা ৯ আগস্ট পিএসসিতে অনুমোদনের চিঠি আসে।

বিধি সংশোধনের ‘ফাঁদে’ চূড়ান্ত ফল, অনিশ্চয়তায় ১৬৯০ ক্যাডার

পিএসসি এখন একটি কমিশন সভা করে পুনরায় ফল প্রকাশ করবে। এরপর সুপারিশপ্রাপ্তদের মেডিকেল টেস্ট ও ভেরিফিকেশন হবে। তারপর গেজেট প্রকাশ করা হবে। কিন্তু পিএসসি সংশোধিত বিধি পেয়েও ৪৪তম বিসিএসের জটিলতা নিরসনে তৎপরতা দেখাচ্ছে না বলে অভিযোগ প্রার্থীদের।

৪৪তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া একজন প্রার্থী নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, বিধি সংশোধনের অনুমোদন পেয়েছে পিএসসি। সরকারের সব দপ্তর থেকে ফাইল এসে এখন পিএসসিতে আটকে আছে বলে জেনেছি আমরা। কিন্তু পুনরায় ফল প্রকাশ করে জনপ্রশাসনে সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকা পাঠিয়ে গেজেট প্রকাশের সুপারিশ করবে, তা করছে না। কেন করছে না, তা নিয়ে কোনো উত্তর নেই।

পুলিশ ক্যাডারে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত আরেকজন প্রার্থী বলেন, চার বছর ধরে একটি বিসিএসের কার্যক্রম চলছে। আমরা ধৈর্য ধরে আছি। এখন চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার পরও আটকে আছি। কবে পিএসসি পুনরায় ফল প্রকাশ করবে, কবে ভেরিফিকেশন হবে, আর কবে গেজেট প্রকাশ করা হবে; কিছুই জানি না। চাকরির বয়স শেষ। যতক্ষণ না যোগদান করতে পারছি, ততক্ষণ ভরসা পাচ্ছি না। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে।

সংকটের নেপথ্যে পিএসসির ‘ব্যস্ততা’

বিসিএসের জট নিরসনে কাজ করছে বর্তমান কমিশন। ৪৫তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা চলমান। ২৪ জুলাই থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা আয়োজন করা হয়। চলতি সপ্তাহে ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের ফল প্রকাশ করে পিএসসি।

আবার ৪৯তম বিশেষ বিসিএসের কার্যক্রমও চলমান। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি টেস্ট। পাঁচটি বিসিএস নিয়ে পিএসসির অতি ব্যস্ততায় ৪৪তম বিসিএসের সুপারিশপ্রাপ্তদের সংকট নিরসনে দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

বিধি সংশোধনের ‘ফাঁদে’ চূড়ান্ত ফল, অনিশ্চয়তায় ১৬৯০ ক্যাডার

পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘৪৪তম বিসিএসের রিপিট ও লোয়ার ক্যাডার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রায় চারশ প্রার্থীর এমন সমস্যা ছিল। এরপর বিধি সংশোধনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা উপদেষ্টা পরিষদে পাঠায়। সেখানে অনুমোদনের পর সচিব কমিটি হয়ে সেটি পিএসসিতে এসেছে। শিগগির এ নিয়ে কমিশন সভা করে পুনরায় ফল প্রকাশ করা হবে।’

পুনরায় ফল প্রকাশ ও সুপারিশপ্রাপ্তদের তথ্য জনপ্রশাসনে পাঠাতে দেরির কারণ জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকগুলো বিসিএস নিয়ে আমরা কাজ করছি। চলতি সপ্তাহেও কয়েকটি বিসিএসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। সেগুলো শেষ করেছি। আগামী সপ্তাহের শুরুতে ৪৭তম বিসিএসের প্রিলি হবে। সবমিলিয়ে কমিশন সভা করা সম্ভব হয়নি। আশা করছি, খুব দ্রুত ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে যে সংকট, সেটা নিরসন করা হবে। সেটা চলতি সপ্তাহের মধ্যেও হতে পারে।’

পদ বাড়ানোর দাবি, না মানলে ‘কঠোর আন্দোলন’

দীর্ঘসময় ধরে বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া চলায় প্রতিটি বিসিএস বিজ্ঞপ্তির শূন্যপদের সঙ্গে আরও কিছু পদ যুক্ত করা হয়। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে মেধাক্রম অনুযায়ী তাতে নিয়োগের সুপারিশ পান প্রার্থীরা। তবে এবার ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পদ বাড়ানো হয়নি। উল্টো আরও অন্তত ২০টি পেশাগত/কারিগরি ক্যাডার পদে যোগ্য প্রার্থী না পেয়ে তা শূন্য রেখেছে পিএসসি।

বিধি সংশোধনের ‘ফাঁদে’ চূড়ান্ত ফল, অনিশ্চয়তায় ১৬৯০ ক্যাডার

৪৪তম বিসিএসে পদ না বাড়ানোয় ক্ষুব্ধ মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা। এ নিয়ে তারা আন্দোলনে নামেন। পিএসসি চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি, মানববন্ধন, বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন। এরপর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে টানা অনশনও করেন। সরকারের আশ্বাসে তারা ফিরে গেলেও এখনও অনলাইন-অফলাইনে পিএসসি সংস্কার ও ৪৪তম বিসিএসে ক্যাডার পদ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের প্রত্যাশা, সংশোধিত ফলাফলে অন্তত ৪০০ পদ বাড়াবে সরকার। এরপরও যদি দাবি পূরণ না করা হয়, তাহলে শিগগির কঠোর আন্দোলনে নামবেন তারা।

আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীরা জানান, ৪৩তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল এক হাজার ৮১৪টি। কিন্তু তা বাড়িয়ে সুপারিশ করা হয় দুই হাজার ১৬৩টি ক্যাডার পদে। ৪১তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল দুই হাজার ১৬৬টি, সুপারিশ করা হয় দুই হাজার ৫২০টি পদে। ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞাপ্তিতে পদ ছিল এক হাজার ৯০৩টি, সুপারিশ করা হয়েছে এক হাজার ৯৬৩ পদে। ৩৮তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল দুই হাজার ২৪টি, সুপারিশ করা হয়েছে দুই হাজার ২০৪টি পদে। অর্থাৎ, ৩৮, ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসের প্রত্যেকটিতে পদ বাড়ানো হয়েছে। অথচ ৪৪তম বিসিএস আরও ২০টি শূন্য রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে থাকাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষার্থী রাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে ৪৪তম বিসিএসের মেধাবীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ছি। আশা করছি, সরকার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসি বিষয়টি অনুধাবন করে পদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করবেন। পদ না বাড়ালে আমরা পুনরায় ঘোষিত ফলাফল মেনে নেবো না।’

বিধি সংশোধনের ‘ফাঁদে’ চূড়ান্ত ফল, অনিশ্চয়তায় ১৬৯০ ক্যাডার

পদ বাড়ছে কি না, সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম। তিনি বলেন, ‘প্রার্থীদের দাবি পূরণে পিএসসি আন্তরিক। কমিশন সভায় এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এএএইচ/এসএনআর/এএসএম

Read Entire Article