দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বিভিন্ন ফসলের চাষ। বর্তমানে এ অঞ্চলে শুরু হয়েছে বিনা চাষে রসুন রোপণের কর্মযজ্ঞ। হালচাষ ছাড়াই রসুন বীজ রোপণ করতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন বিল পাড়ের নারী-পুরুষরা।
জানা গেছে, চলনবিল অঞ্চলে প্রতিবছরই বন্যায় আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কার্তিক-অগ্রাহায়ণ মাসে বিল থেকে পানি নেমে গেলে এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতেই ফাঁকা জমিতে বিনাচাষে রসুন রোপণের ধুম পড়েছে নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর, পাবনার ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ, নাদোসৈয়দপুর, হামকুরিয়া, সগুনাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
অঞ্চলের কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এ মৌসুমে বিনাচাষে ও চাষের মাধ্যমে প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে রসুন চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এ চাষে প্রায় ৩৫ লাখ মণ রসুন উৎপাদন হবে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা জমিতে নরম কাদামাটিতে নারী-পুরুষ মিলে নরম মাটিতে রসুনের কোয়া রোপণ করছেন। বিনা চাষে রসুনের বাম্পার ফলনের কারণে প্রতি মৌসুমে এলাকার কৃষকরা রসুন চাষে ঝুঁকছেন।
তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের নাদোসৈদপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম প্রামানিক বলেন, বর্তমানে ২২০ টাকা কেজি ধরে রসুনের বীজ কিনে পলি জমা কাদা মাটিতে বিনা চাষে সারিবদ্ধভাবে রসুনের কোয়া রোপণ করা হয়। এতে একজন শ্রমিক দিন হাজিরা ৪০০-৪৫০ টাকা করে নিয়ে থাকেন। রোপনকৃত রসুনের ওপর দিয়ে ধানের নাড়া (খড়) বিছিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে প্রতি বিঘা জমিতে ২৫ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি পটাশ, ২০ কেজি জিপশাম ও ২ কেজি বোরন সার প্রয়োগ করা হয়। রোপণের প্রায় ২০-২৫ দিন পর বিঘা প্রতি ১২-১৫ কেজি ইউরিয়া সার দিয়ে পানি সেচ দেওয়া হয়। ৪৫ দিন পর আবার দ্বিতীয় দফা ৮-১২ কেজি ইউরিয়া সার দিয়ে হয়। আর রোপনের প্রায় ১২৫ দিন পর রসুন তোলা যায়।
একই গ্রামের মোহাম্মদ আলী জানান, প্রতি বছরই এই বিলে বন্যায় ধানের ক্ষতি হয় আর এই ক্ষতির কিছুটা পুষিয়ে নিতে আমরা কম খরচে রসুন আবাদ করি। এ বছর ১২ বিঘা জমিতে রসুনের আবাদ করেছি। সবকিছু ঠিক থাকলে আশা করছি ভালো ফলন ও ভালো দাম পাব।
কুন্দইল গ্রামের আরেক কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, অর্থকরী ফসল রসুনের ভালো ফলনের কারণে প্রতি বছরই এ অঞ্চলের কৃষকরা রসুনের রোপণ করে থাকেন। আর প্রতি বিঘা জমিতে চাষ করতে ২৩-২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার বিঘা প্রতি প্রায় ৩৮-৪০ মণ রসুন পাওয়া যাবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা।
শ্রমিক মো. বুলবুল আহম্মেদ, জহুরুল ইসলাম, রমিছা খাতুন, সবুজ হোসেন জানান, রসুন রোপণ করা পরিশ্রমের কাজ। রসুন কোয়া প্রথমে কাটতে হয় তারপর রোদের মধ্যে তা জমিতে কাদা মাটিতে পুঁতে রাখতে হয়। তবুও দিন শেষে ৩৮০-৪০০ টাকা মজুরি দেয়।
রসুনের উপকারিতা সম্পর্কে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আনোয়ার হোসেন জানান, রসুন খেলে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। খালি পেটে রসুন খেলে রক্ত সঞ্চালন বাড়া ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কমায়। কাঁচা রসুন রক্তে থাকা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল, টোটাল কোলেস্টেরল এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদি মো. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন জানান, চলনবিলাঞ্চলে সর্বোচ্চ অর্থকরী ফসলের মধ্যে বিনা চাষে রসুন অন্যতম। এ অঞ্চলের কৃষকরা বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রতি বছরই রসুনের চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়াসহ রসুন চাষে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এবার প্রতি হেক্টর জমিতে ৮.৮৯ টন রসুন উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।