রাজধানীর নিকেতন এখন চলচ্চিত্রের হটস্পট। ঘরে ঘরে প্যানেল। নতুন নতুন গল্পের ঘ্রাণ। কোথাও চলছে সিনেমা সম্পাদনার কাজ, কোথাও বা গানের রেকর্ডিং। বিজ্ঞাপনচিত্রের ভাবনা বিনিময়, শুটিং, মিটিং চলছে তরুণ নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের। তবে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি যুবরাজকে। সমগ্র শহর তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর জানা গেল – যুবরাজ নাকি ঘর বেঁধেছেন বিলের পাড়ে!
গাজীপুরের নন্দীবাড়ি চৌরাস্তায় গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেবে – ওই দিকে থাকে যুবরাজ। চৌরাস্তায় গিয়ে তাই ব্রেক কষি। লুঙ্গি আর ময়লা জামা পরা এক ব্যক্তিকে থামিয়ে হাতের ফোনটি এগিয়ে দিই। বলি, ‘দেখেন তো, এই লোককে চেনেন কি না!’ লোকটা সত্যিই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন, ‘ওই দিকে থাকে। এই রাস্তা দিয়া যানগা সোজা।’ আমরা আবারও বাইক স্টার্ট করি।
যুবরাজের পুরো নাম যুবরাজ শামীম। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকেই তাকে চেনেন। রাশিয়ার মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দুটি পুরস্কার পেয়েছিল তার বানানো সিনেমা ‘আদিম’। নতুন এক সিনেমা বানানোর উদ্দেশে বিলপাড়ে ঘর বেঁধেছেন তিনি। নিকেতনকে অস্বীকার করে সেখানেই থাকছেন, পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে হারিয়ে গেছেন।
সেদিন শনিবার। সকালটা যানজটমুক্ত ছিল বলে গাজীপুর পৌঁছতে অসুবিধা হয় না। গিয়ে জানা যায়, চার নম্বর সিনেমার কাজ শুরু করেছেন যুবরাজ! সেখানেই তার শুটিং সেট, এডিটিং প্যানেল। একা, ভীষণ আনন্দের একটা জীবন যাপন করছেন তিনি। চারদিকে গাছপালা। বিলের পাড়ে দাঁড়ালে অস্ত যাওয়া সূর্য দেখা যায়। সন্ধ্যা নামার সেই দৃশ্য উপভোগ করেন তিনি।
তিনতলা বাড়ির নিচতলায় থাকেন যুবরাজ। শোবার ঘরে সিনেমা সম্পাদনার টেবিল। এখানে বসেই আরও দুটো সিনেমার কাটাকাটি প্রায় শেষ করে এনেছেন তিনি! ঘরময় ছড়ানো ছিটানো বইয়ের মাঝে বসার জন্য একসেট সোফা। তাতে বসে আড্ডা শুরু করি আমরা। দুমাস হলো বিলের পাড়ে এসে ঘাটি গেড়েছেন যুবরাজ। ‘আদিম’ ছবির জন্য বস্তিতে গিয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। এবার কি তবে বিলের গল্প? প্রশ্নটা করতেই যুবরাজ বলেন, ‘গল্পটা আধ্যাত্মিক।’
যুবরাজ জানান, প্রকৃতির কাছে আসার পর প্রকৃতি তাকে একটা গল্প উপহার দিয়েছে। সেটা দিয়েই তিনি বানাবেন নতুন এক সিনেমা। শিগগিরই শুরু হবে শুটিং। তার আগে চলছে সেট নির্মাণ, চরিত্রগুলোকে গল্পের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়ার কাজ। অভিনয়শিল্পীরা সেখানকার স্থানীয়। সেটটাও হবে প্রাকৃতিক। সেসব গল্প বলতে বলতে মনিটরে চালু হয় একটি দৃশ্য। তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি। প্রায় আধঘণ্টা সেসব দৃশ্য দেখানোর পর যুবরাজ যা শোনালেন, তা বিস্ময়ে হতবাক করে দেওয়ার মতো। দৃশ্যগুলো তার নতুন সিনেমার। শিগগিরই হয়তো সেসব দেখবেন কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে জড়ো হওয়া অতিথিরা। আদিমের পর নতুন দুটি সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। মুক্তির জন্য প্রস্তুত। মন সায় দিলে মুক্তি দেবেন, নয়তো দেবেন না ‘অতল’ ও ‘হাজত’ নামের সিনেমা দুটি।
আমরা ঘরের বাইরে যাব। যুবরাজ প্রস্তাব দেন, ‘চলুন, নৌকায় করে বিলটা ঘুরে আসি।’ বাসা থেকে বের হলেই বিলপাড়। সেখানে বাঁধা আছে যুবরাজের ব্যক্তিগত নৌকা। নিকেতন পাড়ার নির্মাতাদের যেমন থাকে সাদা-কালো গাড়ি। সামনের বর্ষায় পানি বাড়লেই শুরু হবে শুটিং। তখন নৌকাটিও অংশ নেবে শুটিংয়ে। গাড়ি-ঘোড়া যখন চাইলেই পাওয়া যায়, তখন নায়কের বাহন কেন নৌকা? জানতে চাইলে যুবরাজ বলেন, ‘অনেক টাকা ব্যয় করে সিনেমা বানাতে চাই না। অল্প পয়সায় খাতা-কলম কিনে যেমন কবিতা লেখা যায়, সেরকম অল্প খরচে সিনেমাও বানানো যায়। কেউ যদি চায়, বানাতে পারে। আমি পারি। সেজন্যই আমি এখানে। তবে বিলপাড়ে বসে আছি, অল্প পয়সায় সিনেমা বানানোর কথা বলছি মানে আমি কিন্তু দরিদ্র নই। আমি আসলে ক্ষুধা পেটে থাকতে চাই।’ পেটে ক্ষুধা থাকলেই সৃজন সহজ হয়, কে যেন বলেছিল কথাটা!
যুবরাজের যাত্রাটা যারা জানেন, তাদের আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক ২০১৮ সালের কথা। ‘আদিম’ ছবির নির্মাণকাজ শুরু হয় তখন। টঙ্গী রেলস্টেশনের পাশের ব্যাংকের মাঠ বস্তির মানুষের গল্প নিয়ে সিনেমাটি বানাতে অনেকবার বাধার মুখে পড়তে হয় তাকে। অর্থের অভাবে শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। তখন সিনেমার শেয়ার বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন যুবরাজ। সেই শেয়ার কিনেছিলেন ৫৩ জন। তাদের অন্যতম আজকের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সিনেমা বানিয়ে তাদের প্রায় সবার টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যুবরাজ। সিনেমাটি দেখিয়েছেন বিশ্বসিনেমা অঙ্গনের বোদ্ধা ও সমালোচকদের এবং সবশেষে সেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। সেই ঘটনা বলে দেয়, সিনেমা বানাতে টাকা নয়, দরকার তীব্র ইচ্ছাশক্তি। যুবরাজ সেই দিক থেকে অনেক শক্তিশালী একজন নির্মাতা।
তবে নির্মাতা, চলচ্চিত্রকার এসব তকমা নিতে নারাজ যুবরাজ। তিনি তাহলে কী? নির্মাতা হিসেবেই তো তাকে আমরা চিনি! এ রকম প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি সার্চার। আমি শিল্পী। লালন কে? তিনি কি একজন গীতিকার? জালালুদ্দিন রুমি, মির্জা গালিবরা কে? তারা তাদের ভাব প্রকাশ করেছেন কবিতার মাধ্যমে। আমার কবিতা হয় না। আমি ভাব প্রকাশ করি ফিল্মের মাধ্যমে। আমি তাদের মতো করে খোদাকে সার্চ করি। সেই সার্চ করার যে জার্নি, সেই ভাবটাই আমি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমি প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছি। যখন আদিম বানাই, তখনকার আমি আর আজকের আমি তো একব্যক্তি না..’
দুপুর তখন বিকেলে গড়িয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা গ্রামের বাজারে পৌঁছাই। সেখানকার ভাতের হোটেলের বেচাকেনা প্রায় শেষ। দেশি মাছ, গরুর ভুঁড়ি দিয়ে আমরা ভাত খেতে বসি। দোকানি বাড়ি থেকে রান্না করে এনে সেখানে বিক্রি করেন। খেতে খেতে যুবরাজকে বলি, ‘সিনেমা কি খাতায় কবিতা লেখার মতো সহজ করে বানানো যায়?’ জবাবে যুবরাজ – চোখ তৈরি করতে পারলেই সিনেমা বানানো সহজ।
খাওয়া শেষে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে যাই একটু দূরে। নির্মাতা যুবরাজ শামীমের ক্যাম্পে। যেন ঢুকে পড়ি সিনেমার সেটে। সেখানে প্রস্তুত নতুন সিনেমার দৃশ্য ধারণের ব্যবস্থা। সিনেমার গল্পটা শোনাতে শোনাতে কুশীলবদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। যুবরাজ বলেন, ‘পানি আর খোলা আকাশ আমাকে টানে। নিকেতনের এসি রুম আমাকে টানে না। যান্ত্রিক জীবন অস্বীকার করে আমি আজ এখানে। আসল শিল্প বের করে আনতে হলে প্রান্তিক মানুষ ও প্রকৃতির ভেতরে থাকতে হয়। এসি রুমে বসে শিল্প সৃষ্টি করা যায় না। যা যায়, তা শিল্প কি না তা নিয়ে বিস্তর আলাপ করতে হবে।’
বিলের ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হঠাৎ আনমনে যুবরাজ বলে ওঠেন, ‘এখানে অনেকবার সূর্যাস্ত দেখেছি। আজকের মতো এত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা হয়নি। কেন যে ভিডিও করতে গেলাম! আগে বুঝলে ভিডিও করা বাদ দিয়ে সূর্যাস্তটাই দেখতাম।’ আমরা দেখলাম রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ।
এমআই/আরএমডি/জিকেএস