সুশিক্ষা, (নৈতিকতা, মানবতা, বিবেক) একটি জাতির মেরুদণ্ড। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও সুশিক্ষিত নাগরিক গঠনের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু, নিরাপদ এবং রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস পরিবেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত মান উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা অনেক দিন ধরেই আলোচনায় আছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে শিক্ষার প্রকৃত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুশৃঙ্খল, নিরাপদ এবং রাজনীতি মুক্ত শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত আবাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সহিংসতা এবং সংঘর্ষের শিকার হয়। এ সমস্যার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আর্থিক সংকট।
ছাত্র রাজনীতি একটা সময় নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে এটি প্রায়ই ক্ষমতার লড়াই এবং সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে।
মূল কারণসমূহ
১. রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার লড়াই: রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তার এবং শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ক্যাম্পাসগুলোকে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বিঘ্নিত করে।
২. নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব: ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বহিরাগতদের প্রবেশ ও সংঘাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সঠিক নিরাপত্তা প্রযুক্তির অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও সুবিধার আকর্ষণ: অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক সংকটের কারণে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যেখানে তারা বিভিন্ন সুবিধা এবং আর্থিক সহায়তা পায়।
করণীয় পদক্ষেপ
১. নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন: ক্যাম্পাসে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ফেস রিকগনিশন, স্মার্ট আইডি কার্ড এবং সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এটি বহিরাগতদের প্রবেশ সীমিত করবে এবং সহিংসতা রোধে সহায়ক হবে।
২. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রশাসন: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে যারা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বে জড়িত নয়। প্রশাসনের মধ্যে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. আর্থিক সহায়তা ও স্টাডি লোন ব্যবস্থা: উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্প সুদে স্টাডি লোন চালু করা উচিত। এ ধরনের আর্থিক সহায়তা শিক্ষার্থীদের পরিবারের আর্থিক চাপ কমায় এবং তাদের স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে সাহায্য করে। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৪. ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম মনিটরিং: ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের ওপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো দরকার। সহিংসতা বা বেআইনি কার্যকলাপে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ধরনের মনিটরিং ব্যবস্থা শিক্ষাঙ্গনের শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
৫. নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং সেমিনারের আয়োজন করা উচিত। এটি তাদের সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলী শেখাবে এবং রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে রাখবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ সুইডেন, জাপান, এবং আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা এবং ক্যাম্পাস ব্যবস্থাপনা থেকে অনেক কিছু শেখা যায়।
• সুইডেনে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন চালানোর জন্য স্বল্প সুদে স্টাডি লোন পায়, যা তাদের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই ব্যবস্থার ফলে তারা রাজনীতির প্রভাব ছাড়াই নিজেদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে।
• জাপানে, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি এবং প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।
• আমেরিকায়, উন্নত মানের ডরমিটরি ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত স্টাডি স্পেস থাকে, যা তাদের শিক্ষাজীবন সহজ করে তোলে। শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপ এবং স্টাডি লোনের মাধ্যমে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, যা তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দেয়।
বর্জনীয় দিকসমূহ
১. রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপ বন্ধ করা: শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন এবং শিক্ষক সমিতিগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
২. সহিংসতা এবং চাপ প্রয়োগ: ছাত্র সংগঠনের সহিংস কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দরকারে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করতে হবে। সহিংসতার সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ: বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের সুযোগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে।
৪. অবৈধ সুবিধা প্রদান রোধ করা: রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে কোনো ধরনের অবৈধ সুবিধা বা ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে, যা শিক্ষার পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
কলুষতামুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলার জন্য সঠিক নীতিমালা, কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং স্বাধীন প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা এবং নেতৃত্ব প্রশিক্ষণও একটি সুস্থ, নিরাপদ, এবং মননশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের ক্যাম্পাসে উন্নত পরিবেশ তৈরি করা দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সঠিক বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারবে, যা ভবিষ্যতে তাদের এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলুষতামুক্ত এবং রাজনীতি-মুক্ত ক্যাম্পাস পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব যদি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যথাযথ বাস্তবায়ন করা যায়। সঠিক প্রশাসনিক নীতি, উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে একটি নিরাপদ ও উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
দেশ গড়তে জাতি গঠনের প্রয়োজন, আর জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে বিশ্বজুড়ে নানা সমস্যার মুক্তভাবে আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সম্মত বা অসম্মতির ভিত্তিতে সমাধান খোঁজা হবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব বাদে প্রায় সবকিছুই ঘটছে—এটাই কষ্ট দেয়। খুন, লুটপাট, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, বিদ্বেষ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিবেকহীন আচরণ, বর্ণ ও বৈষম্যের বিভাজন যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়, তবে সুশিক্ষা ও সৃজনশীলতা কীভাবে বিকশিত হবে?
একটি সুস্থ ও নিরাপদ আবাসিক পরিবেশ ছাড়া সুস্থ মস্তিষ্কের বিকাশ সম্ভব নয়। এই পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, যা একসময় পুরো জাতির ভবিষ্যৎকেই অন্ধকারে ঠেলে দেবে। তাই বিনীত অনুরোধ, আসুন আমরা নিজেরা একত্রিত হয়ে প্রাণবন্ত হই, এবং তারপর একটি সজীব সমাজ ও দেশ গড়ে তুলি।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক ফাইজার, সুইডেন
[email protected]
এমআরএম/জিকেএস