বিষমুক্ত শুঁটকির আধুনিক পদ্ধতি ও চেনার কৌশল

4 hours ago 7

ড. ফোরকান আলী

সূর্যের আলো ও বাতাসের সাহায্যে মাছকে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। শুঁটকি বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণের জন্য পানির পরিমাণ ত্বরিত ১৬-১৮% এর মধ্যে কমিয়ে আনতে হয়। পানির পরিমাণ এভাবে কমে যাওয়ায় পচনে সহায়তাকারী সব অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া মারা যায় এবং মাছের পাচক রসের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শুঁটকিতে আর পচন ধরে না। শুঁটকি তৈরির সময় মাছ থেকে পানি দুই ধাপে বের হয়। এই পানি বেরিয়ে যাওয়ার মাত্রা বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। প্রথম ধাপে মাছের শরীর ভেজা থাকা অবধি পারিপার্শ্বিক বাতাসের বৈশিষ্ট্যের ওপর পানি শুকানোর হার নির্ভর করে। এগুলো হচ্ছে- ক. বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও গতিবেগ; খ. বাতাসের তাপমাত্রা এবং গ. মাছের উপরিতলের পরিমাণ।

দ্বিতীয় ধাপে মাছের গা শুকিয়ে যাওয়ার পর দেহের অভ্যন্তরের পানি শুকানোর হার তিনটি উপাদানের ওপর নির্ভর করে। যেমন- ক. মাছের শরীর গঠনকারী প্রাদানের বৈশিষ্ট্য (চর্বি ও পানির পমিাণ); খ. মাছের পুরুত্ব এবং গ. দেহ তাপমাত্রা। আমাদের দেশে মৌসুমী বায়ুর বিরাট প্রভাব থাকায় শুধু শীতকালে মাছ শুকানো হয়। তবে শীতকালেও আবহাওয়াগত নানা সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন- মেঘলা আকাশ, ঘন কুয়াশা বা দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা ইত্যাদি।

শুঁটকিতে পোকার আক্রমণ

শুঁটকি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের প্রধান সমস্যা হচ্ছে পোকামাকড়ের আক্রমণ। এটাও অনেকটা আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। সাধারণত দুই ধরনের পোকা শুঁটকিকে আক্রমণ করে। যথা- ১. মাছি বা মাছির লার্ভা এবং ২. বিটল বা কাইসসা পোকা। শুঁটকি তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে মাছের আর্দ্র গায়ে মাছিরা ডিম পাড়ে। মাছ তাড়াতাড়ি না শুকালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বা শুককীট জন্ম দেয়। তবে একদিন পর্যাপ্ত রোদ পেলে মাছের পানির পরিমাণ এমন একটা কার্যকরী মাথায় নেমে আসে যে মাছির সাব লার্ভা মরে যায়। আবহাওয়া আর্দ্র বা মেঘলা থাকলে মাছির ডিম পাড়া ও লার্ভায় রূপান্তরিত হওয়ার গতি বহুগুণ বেড়ে যায়। লার্ভারা ৬-১০ ঘণ্টার মধ্য মাছের নরম মাংস খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। খেয়ে খেয়ে বড় হয়ে রূপান্তরের পরবর্তী ধাপে এরা মাচা থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যায়। পূর্ণাঙ্গ মাছিতে পরিণত হওয়ার পরবর্তী রূপান্তরগুলো মাটির ভেতর ঘটতে থাকে।

এ তো গেল মাছির খরব। এবার আসা যাক বিটলের কথায়। নিকষ কালো বর্ণের, ০.৫-১.০ সেন্টিমিটার লম্বা বিটল বা কাইসসা পোকা ঘরের আনাচে-কানাচে, অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় বিস্তর দেখা যায়। এরা সামান্য উড়তে, দ্রুত হাঁটতে বা দৌড়াতে পারে। হাজার প্রজাতির বিটলের মধ্যে শুধু ডারমাসটিস বিটলরাই মাছের শুঁটকিকে আক্রমণ করে। খোলা মাচা বা চাটাইয়ে শুকানোর সময় অথবা শুকানোর পর উন্মুক্ত স্থানে রেখে দিলে ছোট ছোট বিটল পোকাগুলো সন্তর্পণে হেঁটে হেঁটে শুঁটকির বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর বা কোটরে (ফুলকা, উদর গহ্বর, মেরুদণ্ডের খাজ, চক্ষু কোটর ইত্যাদি) ডিম পেড়ে রেখে যায়। অনুকূল পরিবেশে পনেরো থেকে ত্রিশ দিনের মধ্যে সে ডিম ফুটে বাদামি বা মেরুন রঙের লার্ভা বা শুয়াপোকা জন্ম নেয়। লার্ভার শক্ত চোয়ালসহ দাঁত এবং সারা গায়ে লোম থাকে। জন্মের দ্বিতীয় দিন থেকেই এরা মজাদার শুঁটকি খেতে শুরু করে। অনুকূল পরিবেশে এবং নাড়াচাড়া না পড়লে এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত শুঁটকি খেয়ে শেষ করে ফেলে, শুধু হাড়-কাটা অবশিষ্ট থাকে। শুঁটকি সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে বিটল ও শুয়াপোকা একটি বিরাট অন্তরায়। তবে উপর্যুক্ত উভয় ধরনের পোকার আক্রমণে শুঁটকি উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হোন।

এবার পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য উৎপাদিত অধিকাংশ শুঁটকিতে ডিডিটি, নগজ, বাসুডিন ইত্যাদি ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। আজকাল বাজারে এমন শুঁটকি খুব কমই পাওয়া যাবে, যেখানে কীটনাশক মেশানো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এসব কীটনাশকযুক্ত শুঁটকি খেলে মানুষের কিডনি ও লিভার পুরাপুরি অকেজো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অনেকের ধারণা শুঁটকি গরম পানিতে ফুটিয়ে নিলে বা আগুনে রান্না করলে কীটনাশকের গুণাগুণ নষ্ট এবং শুঁটকি বিষমুক্ত হয়। এ ধারণা সঠিক নয়। এসব মারাত্মক কীটনাশকের বিষক্রিয়া আগুনের প্রভাবে আরও শক্তিশালী হয়। তাই মাছের শুঁটকিতে কোনোভাবেই কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত নয়। শুঁটকিতে কীটনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। শুঁটকি তৈরির জন্য আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত। একটু যত্নবান হলে উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শুঁটকির গুণগতমান খুব ভালো রাখা সম্ভব এবং তা দীর্ঘদিন সহজে সংরক্ষণ করা যায়।

নিম্নে শুঁটকিতে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বিশেষজ্ঞদের উদ্ভাবিত কয়েকটি অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতির বর্ণনা দেওয়া হলো:

জালে ঢাকা বক্স টানেল

শুঁটকি তৈরির প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য যন্ত্রপাতি নির্ভর ও খরচ বহুল প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। মাছের পরিচর্যার উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত অবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং প্যাকেজিং পদ্ধতির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে অতি সহজেই উন্নতমানের বিষমুক্ত শুঁটকি তৈরি ও দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করা যায়। উন্নতমানের শুঁটকি উৎপাদনের জন্য হাতের কাছের জিনিসপত্র দিয়ে স্বল্প ব্যয় ও সহজে পরিচালনযোগ্য বক্স-টানেল তৈরি করে নেওয়া যায়। এমন একটি টানেল তৈরির জন্য প্রথমে বাঁশের বা কাঠের খুঁটির ওপর ৩ ফুট উচ্চতায় ৪ ফুট চওড়া ও ২০ ফুট লম্বা একটি বাঁশের আয়তকার মাচা তৈরি করুন। মাচার ওপর সামনের দিকে ক্রমাগত ঢালু করে ২.৫ ফুট এবং সামনের খাড়া পা দুটি ২ ফুট রাখুন। এবার টানেলের ওপর থেকে সারি সারি মাছ ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য ছাদের এক প্রান্তে দূরত্ব পরপর সমান্তরাল করে কতগুলো বাঁশ বেঁধে দিন। ছাদ ঢালু করার ফলে টানেলের ভেতর ঝুলে থাকা প্রতিটি মাছ সমান হারে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পাবে এবং ভেতরে মাছ ঝোলানোর জায়গাও বেড়ে যাবে।

তাছাড়া টানেলের উপরিতলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বেশি সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারবে। টানেলে মাছ ঝুলিয়ে দেওয়ার পর পুরো টানেলটি আগাগোড়া নিশ্ছিদ্রভাবে মশারি জাল দিয়ে ঢেকে দিন। রাতের বেলা ভোর হওয়ার পূর্বেই টানেলে মাছ ঝুলিয়ে নিতে হবে। অন্ধকারে মাছির দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়ে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রাতের বেলা নির্বিঘ্নে টানেলে মাছ তুলে দেওয়া যায়, যা দিনের বেলা কখনোই সম্ভব নয়। দিনে মাছ ঝোলানোর সময় টানেলে প্রচুর মাছি ঢুকে যেতে পারে। টানেলের ভেতর ঝোলানো থাকে বলে দিনের বেলা মাছ উল্টিয়ে এপিঠ-ওপিঠ করে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় মাছের সংস্পর্শে আসতে পারে না। তবে শুঁটকিতে কাইসসা পোকার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মাছ শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টানেল থেকেই ঢাকনাওয়ালা ড্রাম ও শক্ত পলিথিন ব্যাগে ভরে ফেলতে হবে। তারপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়াগায় রেখে সুবিধামতো আকারের টুকরা করে বায়ু-প্রতিরোধী পলিথিন ব্যাগে তৎক্ষণাৎ ভরে প্যাকেটজাত করতে হবে। শুকনা মাছকে কোনোভাবেই খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না।

জালে ঢাকা ঝুলন্ত রিং-টানেল

বাঁশের ঝুলন্ত রিং-টানেল বানিয়ে চারদিক ঘন মশারি জাল দিয়ে ঢেকে তাতে বিভিন্ন ধরনের মাছ শুকানো যেতে পরে। ছোট ও মাঝারি আকারের শুঁটকি ব্যবসায়ীদের জন্য পদ্ধতিটি খুবই কার্যকরী। রিং-টানেল তৈরির জন্য প্রথমে ৪-৫ ফুট লম্বা একটি বাঁশ নিন। ওপরের দিকে একটি গাঁট বাদ দিয়ে বাঁশটিকে লম্বালম্বি ছয় বা আট ভাগে চিরে ফেলুন। এবার বাঁশের কঞ্চি বা চটি দিয়ে তৈরি কয়েকটি রিং আটকিয়ে বাঁশটিকে পলোর আকৃতি দিন। মাছ ঝুলানোর জন্য প্রতিটি প্রান্তীয় রিঙের ভেতর দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে আসা ব্যাসের আরও ৩ বা ৪টি রিং পর্যায়ক্রমে বেঁধে দিন। এভাবে পলোর ভেতর ২ থেকে ৩ স্তরে বাঁশের রিং সাজিয়ে রিং-টানেলটি তৈরি করুন। প্রতি স্তরে তিনটি রিং করে বসিয়ে নিন। রিঙের দুটি স্তরের মধ্যবর্তী ফাঁক বা দৈর্ঘ মাছের দৈর্ঘের ওপর নির্ভর করবে। লইট্টা মাছ শুকানোর জন্য ৩ স্তরবিশিষ্ট রিং-টানেল সাশ্রয়ী ও উপযোগী হলেও ছুরি মাছের জন্য দুই স্তরের অধিক বড় টানেল নাড়াচাড়ায় সমস্যা হতে পারে। বাঁশের চটির পরিবর্তে লোহার পাত দিয়ে তৈরি হলে রিংগুলোকে মাছের আকার অনুযায়ী ইচ্ছামতো ওপর-নিচ করা যাবে।

টানেল তৈরির পর এর চারদিক মশারি জাল দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিন। ভোর হওয়ার পূর্বেই টানেলে মাছ ঝুলিয়ে দিন। মাছসহ রিং-টানেলটি বাঁশে আড়ার মাধ্যমে মাথার ওপর নাগালের বাইরে ঝুলিয়ে রাখুন। লইট্টা, চুরি, পোয়া, রূপচাঁদা ইত্যাদি মাঝারি আকারের মাছ ঝুলিয়ে এই রিং-টানেলের মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে শুকানো যায়। পরপর ৩টি করে রিঙে সাজানো দুই স্তরবিশিষ্ট একটি রিং টানেলে প্রায় ২০ কেজি লইট্টা অথবা ২৫ কেজি ছুরি মাছ শুকানো সম্ভব। ঝুলিয়ে দেওয়া যায় না এমন ছোট মাছ শুকানোর জন্য টানেলের ভেতর রিঙের পরিবর্তে হালকা বুননের বাঁশের চালুনি বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাঁচ ফুট উচ্চতার একটি রিং টানেলের ভেতর ৮ ইঞ্চি অন্তর ৬-৭টি চালুনি বেঁধে অনায়াসে ২০ কেজি ছোট মাছ শুকানো যায়। রিং-টানেলের মাধ্যমে বড় আকারের মাছ যেমন- সুরমা, তাইল্লা, লাক্ষা ইত্যাদিও বিষমুক্তভাবে শুকানো যায়। সে ক্ষেত্রে টানেলের ভেতর রিঙের স্তর বাদ দিয়ে পুরো মাছটি টানেলের মধ্যে নিয়ে মশারি জাল দিয়ে ঢেকে টানেলটি অনেক উঁচুতে ঝুলিয়ে দিতে হবে। শুধু বাণিজ্যিকভাবেই নয়, রিং-টানেল ব্যবহার করে বাড়ির আঙিনা অথবা ছাদে পরিবারে খাওয়ার মতো মাছ শুকানো যায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করে। শুঁটকির মাছি বা অন্যান্য পোকার আক্রমণও পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব।

দেশের মৎস্যজীবী ও প্রক্রিয়াজাতকারীদের উচিত উপযুক্ত বক্স ও রিং-টানেলের ব্যবহার করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিষমুক্ত শুঁটকি তৈরির পদ্ধতি ব্যবহার করা। এ পদ্ধতি হলো, দুপুর ২-৩টার মধ্যে তাজা মাছ কিনুন। পচা বা আঘাত পাওয়া মাছ পরিহার করুন। যথাযথভাবে বরফ দিয়ে মাছ পরিবহন করুন। বড় মাছের ফুলকা, নাড়িভুড়ি ও আইস পরিষ্কার করুন। টিউবওয়েলের পানি দিয়ে মাছ ধুয়ে নিন। বিকেল গড়ালে মাছের গায়ে ৮-১০% পরিষ্কার লবণ মেখে পরিমাণমতো বরফ দিয়ে ৬-৮ ঘণ্টা বরফ বাক্সে রেখে দিন। লইট্টা মাছের ক্ষেত্রে ২-৩% এর অধিক লবণ দেওয়া যাবে না। এই পরিমাণ লবণ শুঁটকিকে লবণাক্ত করবে না বরং মাছ থেকে তাড়াতাড়ি পানি বের করে শুকিয়ে যেতে সাহায্য করবে। লবণমিশ্রিত মাছকে ট্যাংক বা ড্রামে রক্ষিত পরিষ্কার পানিতে ৫ মিনিট ডুবিয়ে ধুয়ে নিন। মাছ খুব পুরু হলে মেরুদণ্ড বরাবর দুই পাশে লম্বালম্বি করে (ছুরি মাছ) অথবা কাঁটার দুই দিকে আড়াআড়ি করে (পোয়া, রূপচাঁদা ইত্যাদি) চিরে ফেলুন। মরিচ ও হলুদের পোকামাকড় নিধনী গুণ রয়েছে। বিধায় সামান্য মরিচ ও হলুদের গুঁড়া একসঙ্গে বা আলাদাভাবে মাছে মাখিয়ে দিন। শতকরা ০.৫ ভাগ শুকনা মরিচের গুঁড়া বেশ কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভোররাতের মধ্যে মাছকে বক্স বা রিং টানেলে তুলে ঘন মশারির নেট দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে দিন। যাতে একটাও মাছি ঢুকতে না পারে। শুঁটকি তৈরির সময়কাল মাছের আকার ও পুরুত্বের ওপর নির্ভরশীল। বড় আকারের রূপচাঁদা ও ছুরি মাছ ৪ দিনে এবং লইট্টা ৩ দিনে শুকানো যাবে। উৎপন্ন শুঁটকি যথাসম্ভব শিগগিরই বড় টেবিলের ওপর রেখে সাইজমতো কেটে চূড়ান্ত প্যাকেট করে ফেলুন। কোনো প্রকার কালক্ষেপণ করবেন না। এতে কাইসসা পোকা বা শুয়াপোকা দ্বারা শুঁটকি আক্রান্ত হতে পারে।

শুঁটকিতে বিটল বা কাইসসা পোকা দমন

আগেই বলা হয়েছে, শুঁটকি সংরক্ষণে কাইসসা পোকা ও শুয়াপোকা একটি বিরাট অন্তরায়। তবে শুঁটকিতে কাইসসা পোকার দমন খুব কঠিন কিছু নয়। যথাযথ পদ্ধতির সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে কাইসসা পোকার হাত থেকে শুঁটকিকে সহজেই রক্ষা করা যায়। কাইসসা পোকা দমনের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হলো একে মাছ বা শুঁটকির সংস্পর্শে আসতে না দেওয়া। এ জন্য শুঁটকির কাঁচামাল বাছাই, লবণ সংরক্ষণ, ধোয়া ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাছকে উন্নত পদ্ধতিতে পলিথিন বা মশারি জাল দিয়ে ঢাকা টানেলে শুকালে কাইসসা পোকা মাছে ডিম পাড়ার সুযোগ পাবে না।

শুঁটকির কাঁচামাল ৬-৮ ঘণ্টার জন্য ৮-১০% লবণ প্রয়োগ করে এর পোকা প্রতিরোধী ক্ষমতা প্রমাণ করা গেছে। টানেলে তোলার পূর্বে কয়েক মিনিট পানিতে ডুবিয়ে ধুয়ে নিলে এই পরিমাণ লবণ শুঁটকিকে লবণাক্ত করবে না। কিন্তু পোকার আক্রমণ অনেক কমে যাবে। কোনো অবস্থাতেই কোথাও খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না। এতে বাইরে থেকে কাইসসা পোকা এসে ডিম পাড়তে পারে এবং পরে শুঁটকির প্যাকেটে শুয়াপোকার আক্রমণ ঘটতে পারে। শুঁটকি শুকিয়ে যাওয়ার পর বিকেলে ঠান্ডা হলে মাচার ভেতর থেকেই বড় নিশ্ছিদ্র পলিথিন ব্যাগে ভরে ফেলতে হবে। পলিথিন ব্যাগটি কোনো প্লাস্টিকের চটের বস্তায় ভরে রাখতে হবে। যাতে খোঁচা খেয়ে পলিথিন ছিদ্র না হয়। তৈরি শুঁটকিকে ঢাকনাওয়ালা প্লাস্টিকের ড্রামে রাখা উত্তম। উৎপন্ন শুঁটকিকে যত দ্রুত সম্ভব সাইজমতো কেটে চূড়ান্ত প্যাকেট করে ফেলতে হবে। কোনো কালক্ষেপণ করা যাবে না। মরিচ ও হলুদের পোকামাকড় প্রতিরোধী গুণ আছে। শতকরা ০.৫ ভাগ মরিচ ও ০.৩ ভাগ হলুদের গুঁড়া একসঙ্গে মাছে মাখিয়ে দিন। মরিচ ও হলুদ মাখা শুঁটকি উৎপাদনের পর সহজে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। ঘরে রক্ষিত উঁচু মাচায় ঠান্ডা জায়গায় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে শুঁটকি সংরক্ষণ করতে হবে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্যাকেটজাত শুঁটকি কোল্ড স্টোরেজে (৩-৪ সেন্টিগ্রেড) সংরক্ষণ করতে হবে। প্যাকেটজাত শুঁটকিকে ডিপ ফ্রিজে ২ দিন মিহায়ন সংরক্ষণ (-১৮ সেন্টিগ্রেড) করে বাজারজাত করা হলে কাইসসা পোকার ডিম ও লার্ভা মারা যাবে। ফলে পরে প্যাকেটের ভেতর পোকার আক্রমণ ঘটবে না। শুঁটকির প্যাকেটের ভেতর ৩-৪টি নিম পাতা গুঁড়া করে রাখলে পোকার আক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা বা নতুন আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।

উপসংহার
অত্যন্ত কম খরচে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে আমরা বক্স বা রিং টানেল ব্যবহার করে এবং স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে বিষমুক্ত শুঁটকি তৈরি করতে পারি। পরিশেষে ক্রেতাসাধারণের উদ্দেশে বলছি, আমাদের দেশে শুঁটকিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল ও মাছকে প্রায়ই সঠিকভাবে পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুঁটকির মাছ পচে যায়। তাই বাজার থেকে কেনার সময় নিরাপদ শুঁটকি শনাক্ত করতে ক্রেতাদের জন্য কয়েকটি টিপস রেখে আলোচনা শেষ করছি। মনে রাখুন, তাজা মাছ থেকে তৈরি শুঁটকির রং হবে চকচকে, দেহ ও পেটের চামড়া হবে উজ্জ্বল বা মসৃণ, সামান্য একটু জিভে ছোঁয়ালে স্বাদহীন বা লবণাক্ত স্বাদ পাওয়া যাবে। শুঁটকির গন্ধ হবে চমৎকার সুন্দর আর আকৃতি হবে কুচকানো। অর্থাৎ শুকানোর পর কুচকে গিয়ে মূল দৈর্ঘের চেয়ে মাছ ছোট হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, পচা মাছ থেকে তৈরি শুঁটকির রং হবে ছাই রং বা ফ্যাকাশে, চামড়া হবে ফাটা-ছেঁড়া বা খসখসে। পেট থাকবে ফাটা বা গলে যাওয়া। জিভে লাগালে তিক্ত স্বাদ পাওয়া যাবে, পচা দুর্গন্ধও থাকতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পচা মাছ থেকে তৈরি শুঁটকির আকার হবে ঢিলেঢালা, কুচকানো নয়। অর্থাৎ শুকানোর ফলে পচা মাছের মেরুদণ্ড প্রসারিত হয়ে শুঁটকি মূল কাঁচা মাছের চেয়ে দীর্ঘকায় হবে। ক্রেতারা এখন থেকে পরখ করে ভালো শুঁটকি নিন। কেনার সময় বিষমুক্ত শুঁটকি চিনবেন কেমন করে? সামান্য একটু জিবে লাগান। তিতা হলেই বুঝবেন এতে বিষ মাখা আছে। সে বিষে আপনার যৎসামান্য ক্ষতি হলেও পুরো পরিবার থাকবে নিরাপদ।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ।

আরও পড়ুন

এসইউ/এমএস

Read Entire Article