নুরুল ইসলাম। রাষ্ট্রস্বীকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভোগ করেছেন নিয়মিত ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধার সব সুবিধা। মুক্তিযোদ্ধা সনদের বিপরীতে ঋণও নিয়েছেন। মৃত্যুর পর গার্ড অব অনারসহ বীরত্বের মর্যাদা দিয়ে দাফনও করা হয়। পরম্পরায় সন্তানরাও তার ভাতা পেয়েছেন। এমনকি ঋণ পরিশোধে সোনালী ব্যাংক তার সন্তানকে চিঠিও দিয়েছে।
এতটুকু পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু মরেও যে নিস্তার নেই বীর মুক্তিযোদ্ধার! কবর থেকেও প্রমাণ করতে হবে তিনিই ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে বিজয়ের মাসে শুনতে হচ্ছে এমন তুঘলকি কাণ্ডের কথা!
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার সনদের দাবি করছেন জীবিত আরেক নুরুল ইসলাম। তিনি ২০২১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (এমআইএস) সৃজন করে প্রথমে হয়েছেন নতুন দাবিদার। এতে সুবিধা করতে না পেরে দুষ্টচক্রের সহযোগিতায় মূল বীর মুক্তিযোদ্ধার এমআইএস সংশোধন করে নিজের ছবি ও তথ্য বসিয়ে নিয়েছেন। মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমআইএস সংশোধনের আবেদন করলে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসে সাপ। মুচলেকা দিয়ে পার পান নতুন দাবিদার। সমাধান চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও দেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। কিন্তু মেলেনি সমাধান। বরং জল ঘোলা হয়েছে আরও বেশি।
আমি মন্ত্রণালয়, ইউএনও অফিস, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় কাগজ নিয়ে যাওয়ায় তার এই অপকর্ম ধরা পড়ে। যার কারণে, তিনি আমাকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে চুপ হয়ে যেতে বলেন।–মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে নাছির
প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার অসহায় ছেলে নাছিরের দাবি, বাবার মৃত্যুর পর আমরা ভাতাও পেয়েছি। তার ব্যাংকঋণ পরিশোধে চিঠিও দিয়েছে। কিন্তু এখন শুনি আমার বাবা নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, এ সনদ আরেকজন দাবি করছেন। পরে খোঁজ নিতে গিয়ে আবিষ্কার করি জীবিত আরেকজন নুরুল ইসলাম জালিয়াতি করে প্রথমে এমআইএস করেছেন। সেখানে তিনি ব্যবহার করছেন আমাদের বাড়ির ঠিকানা। তখন বাবার করে যাওয়া এমআইএস সংশোধন করার আবেদন করি। ইউএনও ভাতা স্থগিত করেন এবং সব পক্ষকে নিয়ে শুনানি করেন। যাবতীয় তদন্ত কাজ করে আমার বাবাকে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও পাঠান। সে বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতির খোঁজ পাইনি।
নাছির বলেন, বিভিন্ন দপ্তরে গেছি, আমার কথা কেউ শোনে না। যেখানেই যাই- জবাব না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তারা বলছেন, আমার দাদার নাম ভুল। আমার দাদার নাম যে ভুল সেটা তো ২০০৫ সালেই সংশোধনের জন্য বাবা হাতে লিখে আবেদন করেছেন। ২০১৮ সালে আবার কম্পিউটারে আবেদন করেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ২০২১ সালে আমিও একই আবেদন করেছি। আমাদের এত সব আবেদনে সাড়া দেয়নি। অথচ টাকা খেয়ে একটি অসাধু চক্র ভুয়া দাবিদার একজনকে স্বীকৃতি দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। যেখানে তার বাবার নামেও মিল নেই।
ঘটনাটি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল এলাকার। এলাকাবাসী ও ডজনখানেক বীর মুক্তিযোদ্ধার দাবি, ‘এখানেই প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের জন্মভিটা। এখানেই তিনি বড় হয়েছেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সব জনসাধারণ তাকে চেনে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তাকে দাফনও করা হয়েছে। এ যাবত মুক্তিযোদ্ধার সব কাগজ তার আছে।’
আমি আবেদনের কোনো কপি দিতে পারবো না। আমি সঠিক কি না, কোর্ট স্বীকৃতি দিয়েছেন, মন্ত্রণালয় দিয়েছে, ডিসি, ইউএনও দিয়েছেন। আবেদনের কপি লাগবে কেন?- নতুন বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার নুরুল ইসলাম
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের সাময়িক সনদ নম্বর ১২৬১৯২, যার স্মারক নম্বর ৫৯/২০০২/৪২৮২, গৌরনদী উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির ২০০৪ সালের ৫ জুন তারিখের সভায় চূড়ান্ত ১ নম্বর তালিকায় তার ক্রমিক নম্বর ৪৮৩, সবুজ ও লাল মুক্তিবার্তা- ০৬০১১০০৬৮২, ১৯৭২ সালে ইস্যু করা ৯ নম্বর সেক্টরের সনদ, ওসমানী সনদ, ২০১৬ সালে ইস্যু করা সরিকল ইউনিয়ন কমান্ডের প্রত্যয়নপত্র, উপজেলা কমান্ডের প্রত্যয়নপত্র, ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যয়নপত্র, মুক্তিযোদ্ধা নম্বর- ০১০৬০০০৩৯৪৮, বেসামরিক গেজেট- ৩৪৯৩, ভাতা বই, ভাতার অ্যাকাউন্ট- ০৩১২১০০০১৪০৫৯। ২০০৯ সাল থেকেই ২০২১ সাল পর্যন্ত ভাতা পেয়ে আসছেন। তিনি ভাতার অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ঋণও পেয়েছেন।
- আরও পড়ুন
বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই সশস্ত্র যোদ্ধা নন
যুদ্ধ করলেন কে আর মুক্তিযোদ্ধা হলেন কে!
টাকা ছাড়া মেলে না গেজেট-সম্মানি, পদে পদে হয়রানি
মুক্তিযুদ্ধ না করেও সনদ নেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
সমস্যা হলো- প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বেসামরিক গেজেটে বাবার নাম আমজাদ আলী হাওলাদারের পরিবর্তে মোসলেম উদ্দিন মুন্সী আসে। সেটিও সংশোধনের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। সেই আবেদনের ২০০৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘রিসিভ’ করা কপিটিও পাওয়া গেছে। এরপর ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ তারিখেও আবার একই আবেদন করেছেন। সেটিরও রিসিভ কপি আছে। এসবে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়। তবে ভুল নিয়েই চলেছে সব। পেয়ে আসছেন ভাতাও।
২০০৫ সালে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার বাবার নাম সংশোধনের আবেদন
সরকারের নানা সময়ে নানা নির্দেশনাও অনুসরণ করেছিলেন নুরুল ইসলাম। এমআইএস সৃজনের নির্দেশনা এলে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ২০২০ সালের ১ আগস্ট এমআইএস সৃজনের আবেদন করেন। কিন্তু ১৭ আগস্ট তিনি ইন্তেকাল করেন। তাকে গার্ড অব অনারসহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। যার ভিডিও আছে।
একজন প্রয়াত বীর মুক্তিযুদ্ধার সনদ নিয়ে এভাবে টানাটানি কাম্য নয়। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এরকম আচরণ উচিত নয়। আমরা জানি, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি রণাঙ্গনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।- মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলের সাব-সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ হক বীর বিক্রম
নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার সন্তান বাবার সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট সংশ্লিষ্ট এমআইসের কাগজ উত্তোলন করেন। ছেলের নামে সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা এবং ওই অ্যাকাউন্টে ভাতার টাকা দেওয়ারও প্রমাণ মিলেছে। এমনকি এমআইএস সংশোধন চেয়ে ২০২১ সালে আবেদনও করেছেন। অবশ্য, এরপরই শুরু হয় যত আজগুবি কাণ্ড।
যেভাবে এলো নতুন দাবিদার
বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট তার উত্তরাধিকার মো. নাছিরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার অনুকূলে ভাতা দেওয়া হয়। তবে, তারও কিছুদিন পরে (২০২১ সাল) এমআইএস সংশোধনের জন্য অনলাইন থেকে ফরম তুলতে গেলে তার বাবার ছবির স্থানে অন্য একজনের ছবি দেখতে পান। পরে জানতে পারেন, পাশের উপজেলা মুলাদীর কোনো এক নুরুল ইসলাম দাবি করছেন, তিনি এই সনদের ব্যক্তি। পরে এ বিষয়ে ইউএনওকে লিখিতভাবে জানালে তিনি ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত ভাতা স্থগিত করেন।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর ২০২১ সালের ১৫ মার্চ ০১০৬০০০৭৯৪৫ নম্বর এমআইএস সৃজন করে নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন নুরুল ইসলাম নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার দাবির পক্ষে যেসব কাগজ পেশ করেন, সেগুলো বেশিরভাগ ২০২১ সালের পরের। ২০২১ সালের আগের যেসব প্রমাণ তিনি দেখান, সেগুলোতে তার বাবার নাম-ঠিকানায় মিল নেই।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে জাগো নিউজ তার কাছে জানতে চেয়েছে- ‘আপনি তো শিক্ষিত সচেতন মানুষ। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন। ২০২১ সালের আগে কেনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও ভাতার আবেদন করলেন না? জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ২০১৮ সালে আবেদন করেছি। এর আগে তো অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দিয়েছে। আমি তো সচ্ছল ছিলাম, সেজন্য আবেদন করিনি।’
অথচ সরকারি তথ্যমতে, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা ২০০৮ সালে চালু হয়েছে। দফায় দফায় ভাতার পরিমাণও বেড়েছে। পাশাপাশি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা বিতরণ নীতিমালা, ২০১৩’ প্রণয়ন করে সরকার।
২০১৮ সালের আবেদনের কোনো কপি আছে কি না? এমন জবাবে নতুন বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আবেদনের কোনো কপি দিতে পারবো না। আমি সঠিক কি না, কোর্ট স্বীকৃতি দিয়েছেন, মন্ত্রণালয় দিয়েছে, ডিসি, ইউএনও দিয়েছেন। আবেদনের কপি লাগবে কেন?’
নতুন দাবিদারের বাবার নাম ও ঠিকানায় অমিল
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নতুন বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার নুরুল ইসলাম তার ২০২১ সাল ও পরবর্তী প্রমাণগুলোতে দেখিয়েছেন- নাম মো. নুরুল ইসলাম, বাবা- মৃত মোছলে উদ্দিন মুন্সী। এটিই তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুযায়ী সঠিক ও প্রকৃত তথ্য। অথচ তিনি ২০২১ সালের আগের যেসব প্রমাণ দেখান সেখানে তার বাবার নাম ও ঠিকানায় মিল নেই। যেমন- লাল মুক্তিবার্তা ও বেসামরিক গেজেটে তার বাবার নাম- মোসলেম উদ্দিন মুন্সী। এদিকে, তার এসএসসি সনদে বাবার নাম- মো. মোছলেহ উদ্দিন (Md Mosleh Uddin)। এনআইডিতে তার বাবার নাম- মৃত মোছলে উদ্দিন মুন্সী।
ঠিকানায়ও আছে বেশ গরমিল। তিনি নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণের জন্য দাবি করছেন, তার ঠিকানা গ্রাম-সরিকল, ডাকঘর- সরিকল, উপজেলা গৌরনদী ও জেলা বরিশাল। তবে এই ঠিকানার পক্ষে তার কোনো প্রমাণ নেই। তিনি কখনোই এই ঠিকানায় ছিলেন না। অনুসন্ধানে গিয়েও তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কোনো হদিস সেখানে পাওয়া যায়নি।
গৌরনদী ইউএনওর দপ্তরে দেওয়া স্বীকারোক্তিতেও নতুন দাবিদার বলেন, ‘আমার পৈতৃক বাড়ি বরিশালের মুলাদী থানাধীন রামচর গ্রামে ছিল। কিন্তু ষাটের দশকে সর্বনাশা আড়িয়াল খাঁ নদী ভাঙনে আমাদের বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আমরা অসহায় সম্বলহীন হয়ে মুলাদী থানাধীন গাছুয়া ইউনিয়নের মধ্য গাছুয়া গ্রামে, আমার নানা বাড়িতে অবস্থান করি।’
আমি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নির্মোহভাবে একটি রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি মুলাদী। তিনি যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে তো তার তথ্য, তালিকা ও সবকিছু থাকার কথা মুলাদীতে। তিনি দাবি করেছেন, কর্মসূত্রে গৌরনদীতে ছিলেন, এখান থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আমি তো পেয়েছি, জীবিত নুরুল ইসলাম কর্মসূত্রে ১৯৮১ সালে গৌরনদীতে এসেছেন এবং দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতা করেছেন। যুদ্ধ তো হয়েছে, আরও অনেক আগে।- তৎকালীন ইউএনও বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস
তিনি দাবি করেছেন, ‘পৈতৃক বাড়ি মুলাদী হওয়া সত্ত্বেও আমি আমার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় সরিকলে কাটিয়েছি।’
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তিনি কর্মজীবন শুরু করেছেন ১৯৮১ সাল থেকে। তাও সরিকল নয়, হোসনাবাদ গ্রামে। ১৯৮১ সালের ২৩ নভেম্বর গৌরনদী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের নিজামউদ্দিন ডিগ্রি কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এমপিওভুক্ত হয়েছে ১৯৮৫ সালের ১ মার্চ। ইনডেক্স নম্বর ০০১১০৯।
প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার সময়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়। তবে, ৬০ দশকের পর থেকে মুলাদীর গাছুয়া গ্রামে তিনি ছিলেন, এখনো আছেন এটা প্রমাণিত।
তিনি দাবি করেছেন, ‘আমি ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে হিজলা থানার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলাম। পরে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ১৯৬৯ সালে যশোর শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন তিনি।
সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন মোল্লার দেওয়া তথ্য বলছে, ‘সরিকল ইউনিয়নে নতুন দাবিদার নুরুল ইসলামের কোনো বসতগৃহ বা ইউনিয়ন খানা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তিনি বাবুগঞ্জ থানার ১ নম্বর বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের তিলের চর গ্রামে ঘর করে বসবাস করতেন, পরে এটিও বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।’
গৌরনদীর তৎকালীন ইউএনও বিপিন চন্দ্র বিশ্বাসের তদন্তেও উঠে এসেছে, নুরুল ইসলাম কখনো গৌরনদী উপজেলায় বসবাস করেননি। নিজামউদ্দিন ডিগ্রি কলেজে শিক্ষক থাকাকালে তিনি বাবুগঞ্জের তিলের চর গ্রামে বসবাস করতেন।
২০১১ সালে ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রেও নতুন বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার নুরুল ইসলামের বাবার নাম- মৃত মোছলে উদ্দিন মুন্সী, মায়ের নাম: মৃত নুরজাহান বেগম। জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি ১৯৫৩। ঠিকানা: গ্রাম/রাস্তা: মধ্য গাছুয়া, ডাকঘর: সৈয়দের গাঁও-৮২৫০, মুলাদী, বরিশাল।
ভাতা দাবি ত্যাগের মুচলেকা, পরে সেটি অস্বীকার
কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সেটি নিরূপণের জন্য দফায় দফায় তদন্ত করে প্রশাসন। এর মধ্যে মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মো. নাছিরের এমআইএস সংশোধনের জন্য করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গৌরনদীর ইউএনও বিষয়টি তদন্ত করেন। সেই তদন্তের প্রতিবেদন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামই প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
ইউএনও’র তদন্তের সময় ভাতা প্রদান কমিটির সদস্য সচিব সুশান্ত বালা, উপজেলা সমাজেসেবা কর্মকর্তা এবং উপজেলার বেশিরভাগ বীর মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে ২০২১ সালের ৩০ জুন শুনানি গ্রহণ করা হয়। এতে মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের ছেলে নাছির ও জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিকালে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সভায় বলেন, ‘আমি যে ভাতা পেতাম তা আমার ছিল না। এ ঘটনা জানার পরে আমি উক্ত ভাতার দাবি ত্যাগ করলাম।’
তদন্তকারী সেই ইউএনও জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুনানিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ভবিষ্যতে আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দাবি করবেন না বলেও মুচলেকা দেন।’
নাম/তথ্য সংশোধন দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় ২০১৮ সালে আবার আবেদন করেন প্রয়াত নুরুল ইসলাম
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নুরুল ইসলাম নিজের হাতে লেখেন ওই মুচলেকা। যার মূল কপি সমাজসেবা অফিস, গৌরনদীতে সুরক্ষিত। সমাজসেবা কর্মকর্তাকে মাধ্যম রেখে ইউএনও বরাবর দেওয়া ওই আবেদনে (মুচলেকা) নুরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‘আমি মো. নুরুল ইসলাম, বাবা: মোসলেম উদ্দিন, গ্রাম ও পো: সরিকল, উপজেলা: গৌরনদী, জেলা: বরিশাল। আমার গেজেট নম্বর: ৩৪৯৪, মুক্তিবার্তা নম্বর: ০৬০১১০০৬৮২ আমি যে ভাতা পেতাম তা আমার ছিল না। এই ঘটনা জানার পর আমি উক্ত ভাতা দাবি ত্যাগ করলাম।’ এতে সাক্ষী হিসেবে সনদধারী চারজন মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরও আছে।
অবশ্য ১৮ দিন পরে এই মুচলেকা ও বৈঠকে দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করে ২০২১ সালের ১৮ জুলাই একটি লিখিত বক্তব্য ইউএনও অফিসে জমা দেন জীবিত সেই মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার নুরুল ইসলাম। সেখানে তিনি দাবি করেন, ‘শুনানিকালে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ অসুস্থ ছিলাম, আমার কথাবার্তায় হয়তো বা অনেক ভুল বলে থাকতে পারি।’
অথচ জাগো নিউজের অনুসন্ধানকালে নুরুল ইসলাম নিজেই স্বীকার করেন ইউএনও’র কাছে মুচলেকা দেওয়ার সময় তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন। ভাতা দাবি করবেন না, এমন মুচলেকাও দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বলেছি, আমি ভাতা দাবি করবো না। কারণ তখন আমাকে বলা হয়েছিল, এটা আমার গেজেট না। এই গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তা তার (প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার)। এভাবে একটা প্রতারণা তখন করা হয়েছিল। পরে দেখা গেলো- ওর (প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার) কিছুই নেই। তখন আমি মন্ত্রণালয় থেকে কাগজ বের করলাম। সে একটা ভুয়া এমআইএস বের করছিল। আমার সব সঠিক আছে। আমার কোনো কাগজপত্রে ভুল নেই।’
মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে ৫ লাখ টাকা প্রস্তাব
অনুসন্ধানে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তার অসচেতন ও অশিক্ষিত ছেলে-মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। তারা বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম সংশোধন করে দেওয়ার পরিবর্তে আরেকজনকে দাবিদার দাঁড় করিয়েছেন। এমনকি অর্থের বিনিময়ে যোগসাজশে এটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলছেন প্রায়। ধরা পড়েছেন ইউএনওর তদন্ত ও গণশুনানিতে।
এরই মধ্যে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মো. নাছিরকে পাঁচ লাখ টাকাও প্রস্তাব করেছে অসাধু চক্র। এ সংক্রান্ত একটি রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতেও এসেছে।
নাছির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মন্ত্রণালয়, ইউএনও অফিস, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় কাগজ নিয়ে যাওয়ায় তার এই অপকর্ম ধরা পড়ে। যার কারণে, তিনি আমাকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে চুপ হয়ে যেতে বলেন।’
এ বিষয়ে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি প্রস্তাব দিয়েছি। শাহজাহান নামে এক ব্যক্তির অনুরোধে অফারটা দিয়েছি।’
যা বলছেন নুরুল ইসলামের সতীর্থরা
মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলের সাব-সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ হক বীর বিক্রমসহ গৌরনদীর ১২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউএনওর শুনানিতে সাক্ষী দিয়েছেন যে, প্রভাষক নুরুল ইসলাম যার বাড়ি মুলাদীর গাছুয়া, তাকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কখনো গৌরনদী এলাকায় কোনো রণাঙ্গনে দেখেননি, চেনেনও না। তাকে কেবল প্রভাষক হিসেবে চেনেন। রণাঙ্গনে ছিলেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, বাবা আমজাদ আলী হাওলাদার, তার গ্রামের বাড়ি গৌরনদী উপজেলার সরিকল গ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলের সাব-সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ হক বীর বিক্রম জাগো নিউজকে বলেন, ‘একজন প্রয়াত বীর মুক্তিযুদ্ধার সনদ নিয়ে এভাবে টানাটানি কাম্য নয়। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এরকম আচরণ উচিত নয়। আমরা জানি, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি রণাঙ্গনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মৃত্যুর পর নুরুল ইসলামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিনতাই করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন আকন, আবদুল মান্নান, সমাজসেবা অফিসের কেরানি নুরুজ্জামানসহ কতগুলো বদমাইশ এটা করেছে। এখন যিনি নতুন দাবিদার তার বাড়িও গৌরনদী নয়। তিনি মুলাদী উপজেলার গাছুয়া থেকে ১৯৮১ এর পরে শিক্ষকতা করতে এসেছেন। তাকে প্রভাষক নুরুল ইসলাম হিসেবে চিনি। তিনি কোথাও মুক্তিযুদ্ধ করেননি। নিজেও স্বীকার করে মুচলেকা দিয়ছেন। এ বিষয়ে আমরাও ইউএনওর কাছে সাক্ষ্য দিয়েছি। আদালত যদি আমাদের ডাকে, বা কেউ যদি আদালতে নিয়ে যায় আমরা একই সাক্ষী দেবো।’
দুই দাবিদারের কোনজন সঠিক? এমন প্রশ্নের জবাবে আরেক সতীর্থ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী গোলাম মোর্শেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সঠিক হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, পিতা আমজাদ আলী হাওলাদার, বাড়ি গৌরনদী উপজেলার সরিকল গ্রামে।’
নতুন দাবিদার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুচলেকা দিয়ে ভাতা দাবি প্রত্যাহার করেন
নতুন দাবিদার কীভাবে এলো? জবাবে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘ওটা আসছে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর। আওয়ামী লীগের কিছু খাউয়া ডাকাত মেজবাহ আকন, মন্নান, সোহরাব জমাদ্দার, শাহজাহান হাওলাদার, নুরুল ইসলাম হাওলাদারসহ আরও কয়েকজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তাকে আনছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পিতার নামের সংশোধনের আবেদনের পর সেই সুযোগ নিয়ে প্যাকেট ভাগাভাগি করবে, ভাতার অর্ধেক টাকা নেবে সেই চুক্তি কইরা ঢুকাইছে।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
গৌরনদীর তৎকালীন ইউএনও বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নির্মোহভাবে একটি রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি মুলাদী। তিনি যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে তো তার তথ্য, তালিকা ও সবকিছু থাকার কথা মুলাদীতে। তিনি দাবি করেছেন, কর্মসূত্রে গৌরনদীতে ছিলেন, এখান থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আমি তো পেয়েছি, জীবিত নুরুল ইসলাম কর্মসূত্রে ১৯৮১ সালে গৌরনদীতে এসেছেন এবং দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতা করেছেন। যুদ্ধ তো হয়েছে, আরও অনেক আগে।’
বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, অন্য জনপ্রতিনিধি, কলেজের অধ্যক্ষ থেকে তথ্য নিয়েছি। মুলাদীর ইউএনওর মাধ্যমেও তার এলাকার তথ্য নিয়েছি। তিনি কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, সেটি খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি সেটার সঠিক জবাব দিতে পারেননি। অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে যখন শুনানি নিয়েছিলাম, তিনি (জীবিত নুরুল ইসলাম) স্বীকার করেছেন যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। লিখিত আকারে একটি মুচলেকাও দিয়েছেন।’
তৎকালীন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার আগের অফিসারের সময়ে এমআইএস তৈরি করেছেন নতুন বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার নুরুল ইসলাম। আমি এসে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও স্যারের নির্দেশে ভাতা স্থগিত করি। এ নিয়ে দুই পক্ষ ও অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে ইউএনও স্যার শুনানিও করেছিলেন। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার তার তেমন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি নিজে মুক্তিযোদ্ধা নন বলেও স্বীকার করেছেন। একটি মুচলেকাও দিয়েছেন।’
সুশান্ত বালা বলেন, ‘আমরা কাগজপত্র ও বিভিন্নজনের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখেছি, আসলে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামই প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ওনার ছেলে নাছির খুবই অসহায়। সে যদি তার বাবার স্বীকৃতি ও সুবিধা পায়, আমিও খুশি হবো।’
গৌরনদীর নিজামউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নুরুল ইসলাম সাহেবকে চিনি। আমার সহকর্মী ছিলেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অতিরিক্ত যে চাকরির মেয়াদ পান, সেটার জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হয়নি।’
এসইউজে/এএসএ/এমএমএআর/জেআইএম