দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিবিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বড় পরিবর্তন আসছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। প্রস্তাবিত নতুন সংশোধনীতে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ চিহ্নিত করার বিধানটি বাতিলসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইতোমধ্যে সংশোধিত খসড়া অনুমোদন করেছে এবং আগামী মাসেই এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হতে পারে।
কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির ধারা
২০২৩ সালের আইনে প্রতিটি ব্যাংককে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা ছিল। তারপর শুনানি, আপিলসহ নানা ধাপ পেরিয়ে নাম চূড়ান্ত করা যেত।কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, এই প্রক্রিয়াটি এতটাই জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছিল যে বাস্তবে কাউকে চূড়ান্তভাবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। তাই, আইনটি অকার্যকর হওয়ায় এটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঋণখেলাপিদের জন্য বিধিনিষেধ বহাল থাকছে
যদিও ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা বাতিল হচ্ছে, এর মানে এই নয় যে ঋণখেলাপিরা পুরোপুরি ছাড় পাচ্ছেন। বরং, তাদের ওপর আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ আগের মতোই কার্যকর থাকবে। যেমন- নতুন ঋণ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা, বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ, ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার অযোগ্যতা ইত্যাদি।
নতুন সংশোধনীতে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হচ্ছে:
গ্রুপ কোম্পানির ঋণগ্রহণে শিথিলতা বাতিল
আগে কোনো গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি না হলে, একই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ঋণ নিতে পারতো। নতুন প্রস্তাবনায় এই শিথিলতাটি বাতিল করা হচ্ছে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও বড় পরিবর্তন
নতুন আইনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সর্বোচ্চ পরিচালক সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১৫ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮ জন হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক এবং তাদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান থাকছে। এছাড়া পরিচালকের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করা হচ্ছে। একই পরিবারের সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ৩ জন থেকে ২ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। পরিবারের সংজ্ঞাও প্রসারিত করা হয়েছে, যেখানে শ্বশুরপক্ষ এবং ভাই-বোনের স্বামী/স্ত্রীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলো মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য আনা হচ্ছে। ২০২২ সালে আইএমএফ-এর ঋণ কর্মসূচির অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক প্রভাব কমানো এবং পরিচালকদের মেয়াদ সীমিত করা।কেননা, ২০০১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময় নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেশ কিছু শিথিলতা আনা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত না করার সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন প্রশাসনিক জটিলতা কমাবে, অন্যদিকে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগও সীমিত করবে।
ব্যাংকিং বিশ্লেষক চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, যারা পরিকল্পিতভাবে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো স্পষ্টতা না থাকলে তা ভবিষ্যতে খেলাপির সংখ্যা আরও বাড়াতে পারে।
অন্যদিকে, আরেক পক্ষ যুক্তি দিচ্ছে যে বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সময় বা প্রক্রিয়ার জটিলতা না থেকে সরাসরি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সরকার মনে করছে, এই সংশোধনীর মূল লক্ষ্য হলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
ইএআর/কেএইচকে/জেআইএম