ভবদহ অঞ্চলের চার দশকের দুঃখের অবসানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভবদহের জলযন্ত্রণা থেকে পানিবন্দি লাখো মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে একগুচ্ছ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার, যা একনেকের সভায় অনুমোদন হয়েছে।
প্রকল্পের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আগামী মাস থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবদহ সংলগ্ন ৮১ কিলোমিটার নদী খননের কাজ। এর আগে আমডাঙ্গা খাল খনন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের ৪৯ কোটি টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি মাসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং মেজর পদমর্যাদার সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের নেতৃত্বে ভবদহ এলাকায় সমীক্ষা চলেছে।
এদিকে টিআরএমে (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) আরও উন্নত প্রযুক্তিতে পলি অপসারণ হবে, এ নিয়ে আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়ার মডেলিং) প্রতিষ্ঠান ভবদহ এলাকায় সমীক্ষা চালাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন এবং সেনাবহিনীর সঙ্গে পাউবো’র এমওইউ (মেমোর্যান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) বা সমঝতা স্মারক হলেই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতিসাপেক্ষে কাজ শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট পাউবো সূত্রে জানা গেছে।
ভবদহ স্লুইসগেটের ইতিবৃত্ত
যশোর ও খুলনা জেলাধীন মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, যশোর সদর উপজেলা, ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও বটিয়াঘাটা উপজেলাধীন এক লাখ ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে লবণ পানি ঢুকে প্রতি বছর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে থাকে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই অঞ্চলে সবুজ বিপ্লবের নামে টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর প্রথম স্লুইসগেট নির্মাণ করে। এ ছাড়া এই এলাকায় তিনটি পোল্ডার, ১০ হাজার ৫৬৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৮২টি স্লুইসগেট নির্মিত হয়। কিন্তু ৮০র দশকে পলি জমে এই এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে আজ স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে।
তবে, ৫০ বছর মেয়াদের এই স্লুইসগেট নির্মাণের পর ৬০ বছর পার হয়ে গেছে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই গেট। যে কারণে সব গেট একবারে খুলে দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। কম সংখ্যক গেট খুলে পানি সরানো হচ্ছে।
ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসনে যত প্রকল্প
জলাবদ্ধতা নিরসনে এ যাবত প্রায় হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সিংহভাগ অর্থ লুটপাট হয়েছে দাবি পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটিসহ ভুক্তভোগীদের। ১৯৯৬ সালে কেজেডিআরপি’র (খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহেবিলেশন প্রকল্প) আওতায় ২২৯ কোটি, ২০০২ সালে খুলনা-যশোর পানি নিষ্কাশন প্রকল্পের আওতায় ২৫২ কোটি, ২০০৬ সালে ৬৯ কোটি, ২০১১ সালে ৭১ কোটি, ২০১৪ সালে ৪৪ কোটি, পাম্প ও বিভিন্ন সময় পলি অপসারণসহ নানা প্রকল্পে সবমিলিয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তয়নে দুর্নীতি ও কৃষক বিক্ষোভ
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতা বিশ্বজিত জানান, ২০০৬ সালে ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বিল খুকশিয়ায় টিআরএম প্রকল্পের বাস্তবায়ন করে। কৃষকরা ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ পাণ। কিন্তু ২০১১ সালে ৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে বিল কপালিয়ায় টিআএম প্রকল্প চালুর উদ্যোগ নিলেও কৃষকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে নানা টালবাহানা করলে স্থানীয়রা ফুঁসে ওঠেন। একপর্যায়ে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ২০১২ সালের ৫ মে টিআরএম উদ্বোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তৎকালীন হুইপ আব্দুল ওহাবসহ পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কৃষকদের তোপের মুখে পড়েন এবং হামলার শিকার হন। এতে হুইপসহ কর্মকর্তার একাধিক গাড়ি ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ কৃষকরা।
বর্তমান ভবদহ সংকট উত্তরণে গৃহীত যত প্রকল্প
আমডাঙ্গা খাল খনন প্রকল্প : পাউবোর (পানি উন্নয়ন বোর্ড)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আমডাঙ্গা খাল খননে ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। পাউবোর সঙ্গে ডিএলএস (ডিস্ট্রিক ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন) বা জমি অধিগ্রহণ সমঝতা হলেই কাজ শুরু হবে।
এরমধ্যে জিকরা খাল পর্যন্ত ২ দশমিক ২ কিলোমিটার আমডাঙ্গা খাল প্রশস্তকরণ ও গভীর করে খনন করা হবে এবং এই মাটি দিয়ে একইসঙ্গে খালের দুইধারে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া দুইটি কালভার্ট খালের প্রশস্তের সমানসহ আমডাঙ্গা খালের রেগুলেটর হতে ভৈরব নদ পর্যন্ত ৩৩ ফিট প্রশস্ত ও গভীর করে ৪৫০ মিটার আরসিসি ইউ ড্রেন করা হবে। মানুষের ভোগান্তি না হয়; সে জন্য ইউ-ড্রেনের ওপর দুটি ছোট সেতু নির্মাণ হবে। পাশাপাশি ইউ-ড্রেনের দুই পাশে মানুষের চলাচলের জন্য ৫ ফিট প্রশস্তের রাস্তা নির্মাণ করা হবে।
নদী খনন প্রকল্প : বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮১.৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আপার ভদ্রা, হরিহর, হরি, টেকা ও শ্রী নদী খনন করা হবে। ইতোমধ্যে গৃহীত এই প্রকল্পের সকল পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করে গত ১৯ জুন একনেকের সভায় অনুমোদন হয়। চলতি মাসের ১৭ থেকে ১৮ আগস্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং মেজর পদমর্যাদার সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের নেতৃত্বে ভবদহ এলাকায় সমীক্ষা চলেছে।
এই কাজ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শুরু হবে। ভবদহে সমীক্ষাকারী আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়ার মডেলিং) প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন এবং সেনাবহিনীর সঙ্গে পাউবোর এমওইউ (মেমোর্যান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) বা সমঝতা স্মারক হলেই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে আগামী সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কাজের উদ্বোধন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ওয়াটার মাস্টার মেশিন ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প প্রকল্প : দেশে প্রথমবারের মতো ওয়াটার মাস্টার মেশিন কেনা হচ্ছে। এই মেশিন একইসঙ্গে নদী খনন, পলি অপসারণ, ড্রেজিং একং কচুরিপনা অপসারণ করতে সক্ষম, যা বছরজুড়েই ভবদহ এলাকায় থাকবে। ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইডেন থেকে কেনা হচ্ছে এই মেশিন। এ ছাড়া ৩৫ কিউসেক পানি অপসারণ উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ৮টা পাম্প কেনা হচ্ছে। যার ৫টি ভবদহে স্থাপন করা হবে এবং কেশবপুর উপজেলার বিলখুকশিয়ায় সাবস্টেশনসহ বাকি তিনটা পাম্প স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্পে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। চলতি মাসের ৮ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশন হতে অনুমোদন হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রাণালয়ের দাপ্তরিক কাজ শেষ হলেই অনলাইন টেন্ডারিং করা হবে।
পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি ও ভুক্তভোগীদের অনুভূতি : পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি জানান, পূর্বের যত প্রকল্প সবই লুটপাট হয়েছে। তাদের বরাবরই দাবি ছিল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে ভবদহ প্রকল্প কাজ বাস্তবায়ন।
কার্ত্তিক মল্লিক, কাকলী রাণী, উৎপল বিশ্বাস, হীরামনসহ একাধিক ভুক্তভোগী জানান, পূর্বে ভবদহ সংকট নিরসনে আশ্বাস দিলেও কাজ হয়নি। এ কারণে এলাকায় অধিকাংশই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তবে, যেহেতু এবার সেনাবাহিনীর অধীনে বাস্তবায়ন হবে, এই কারণে একটু আশার আলো দেখছেন তারা।
পাউবো যশোর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি লাঘব হবে বলে তিনি আশা করছেন।