ভাইফোঁটায় ঘরে ঘরে ভ্রাতৃস্নেহের আনন্দ

4 hours ago 8
বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন উৎসব ভাইফোঁটা। এটি শুধুই একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং ভাইবোনের চিরন্তন স্নেহ, মমতা ও পারস্পরিক ভালোবাসার প্রতীক। বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সারা দেশে হিন্দু পরিবারে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়েছে ভাইফোঁটা। সকাল থেকেই ঘরে ঘরে চলেছে পূজা, প্রার্থনা, ফোঁটা দেওয়া, উপহার বিনিময় আর খাবারের আয়োজন। কার্তিক মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে উদযাপিত হয় ভাইফোঁটা। এই দিনটি ভাই-বোনের সম্পর্ককে আরও গভীর ও মধুর করে তোলে। বোনেরা স্নান সেরে পবিত্র মনে ভাইয়ের কপালে কালি বা কাজল, চন্দন, দই, সিঁদুর ও চাল মিশিয়ে ফোঁটা দেন এবং তার দীর্ঘায়ু, মঙ্গল ও সর্বাঙ্গীণ সুখ কামনা করেন। ফোঁটা দেওয়ার সময় উচ্চারিত হয় প্রার্থনার ছন্দময় মন্ত্র—‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা; যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা। যম যেমন হয় চিরজীবী, আমার ভাই যেন হয় তেমন চিরজীবী।’ এই মন্ত্রে ফুটে ওঠে বোনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গল কামনা। ভাইফোঁটার শিকড় নিহিত প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীতে। দেবী যমুনা ও তার ভাই যমরাজের গল্প থেকেই এ রীতির সূচনা বলে মনে করা হয়। কাহিনী অনুযায়ী, যমরাজ বহুদিন পর যমুনার বাড়ি এলে বোন তাকে স্নেহভরে আহার করান এবং কপালে ফোঁটা দেন। যমরাজ তখন বলেন, ‘যে ভাইয়ের কপালে বোন এই দিনে ফোঁটা দেবে, সে যেন অকালমৃত্যু থেকে মুক্তি পায়।’ সেই থেকেই প্রতি বছর কার্তিক মাসের এই দিনে ভাইফোঁটার প্রথা পালিত হয়। ফোঁটা দেওয়ার আগে বোন স্নান করে নতুন পোশাক পরেন, ঘর পরিষ্কার করে পূজার থালি সাজান। থালিতে থাকে কালি বা কাজল, চন্দন, দই, ধান, দূর্বা, শঙ্খ, প্রদীপ, মধু ও বিভিন্ন উপকরণ। নির্দিষ্ট সময়ে বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে ফোঁটা দেওয়া হয়। কারণ সনাতন শাস্ত্রমতে, এই আঙুল ‘ব্যোম’ বা আকাশ তত্ত্বের প্রতীক। আকাশের মতোই সম্পর্ক যেন হয় অটুট ও অসীম—এই বিশ্বাসেই রীতি অনুসরণ করা হয়। ফোঁটা দেওয়ার পর ভাইকে আশীর্বাদ করা হয় ধান ও দূর্বার শীষ স্পর্শ করে। এরপর ভাই-বোন একে অপরকে উপহার দেন, মিষ্টিমুখ করানো হয়, আর ঘরে ঘরে চলে বিশেষ খাবারের আয়োজন। লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম, পায়েস, সন্দেশসহ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারে সাজানো হয় ভাইফোঁটার আয়োজনে ভরা দুপুরের ভোজন। ঢাকাসহ দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে এ দিন সকাল থেকেই ছিল উৎসবের আমেজ। বোনেরা ভোরে উঠে ঘর পরিষ্কার করে, ফুল দিয়ে সাজান পূজার আসন। ভাইদের জন্য তৈরি করেন প্রিয় খাবার। অনেক পরিবারে ছোটদের নিয়ে হাসিখুশি পরিবেশে চলে ‘ফোঁটা দাও, মিষ্টি খাও’ আয়োজন। অনেক জায়গায় আত্মীয়-স্বজন একত্র হয়ে ছোটখাটো মিলনমেলার আয়োজন করেন। বোনেরা একে অপরের ঘরে গিয়ে ভাইফোঁটা দেন, কেউ কেউ ভিডিওকলে দূরে থাকা ভাইদেরও শুভেচ্ছা জানান। ফলে ধর্মীয় রীতি ছাড়াও এটি পরিণত হয় পারিবারিক সংযোগ ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য উৎসবে। ভাইফোঁটার মূল ভাবনা শুধু ধর্মীয় নয়, মানবিকও। এ দিনে বোনেরা প্রার্থনা করেন ভাইয়ের মঙ্গল ও সুরক্ষার জন্য, আর ভাইয়েরা প্রতিজ্ঞা করেন জীবনের প্রতিটি বিপদে বোনের পাশে থাকার। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, স্নেহ ও সহমর্মিতা। ভাইফোঁটা স্মরণ করিয়ে দেয় ভালোবাসা, যত্ন আর পরিবারই মানুষের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। বছরের এই বিশেষ দিনটি তাই শুধু ফোঁটা দেওয়ার নয়, একে অপরের প্রতি হৃদয়ের বন্ধন নবায়নেরও দিন। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের উপদেষ্টা পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী কালবেলাকে বলেন, ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান সাধারণত ঘরোয়াভাবে, বাসাবাড়িতে পালন করা হয়। বোন তার ভাইকে ফোঁটা দেয় এবং একই সঙ্গে ভাইও বোনের বাড়িতে গিয়ে ফোঁটা নেওয়ার পাশাপাশি  আহার গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ভাই-বোন একে অপরকে উপহারও দেয়—এভাবেই প্রথা অনুসৃত হয়।
Read Entire Article