ভাগ্য না বদলানো চরবাসীর দুঃখগাথা

2 weeks ago 19

উত্তরের জেলা গাইবান্ধা। জেলার সাত উপজেলার মধ্যে সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা চরবেষ্টিত এলাকা। উপজেলাগুলোতে কমপক্ষে ২০টি ইউনিয়নে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এসব চরের বাসিন্দাদের জীবন কাটে নিদারুণ কষ্টে। তারা প্রকৃতির সঙ্গে লড়ই করে বেঁচে থাকেন। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এসব মানুষের জীবন কাটে অর্ধাহারে অনাহারে। নদীভাঙনের করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে ছুটে বেড়ায় এক চর থেকে অন্য চরে। প্রবল নদীভাঙনের কারণে অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেই কোনো চিহ্ন। এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এ অঞ্চলের মানুষেরা তাদের অনেক মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত।

চরাঞ্চলের সম্ভাবনা

যেসব এনজিও এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চরাঞ্চল এবং উপকূলের মানুষের উন্নয়নে সীমিত পরিসরে কাজ করে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব এলাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে, যা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ ভাগ। চরাঞ্চলগুলোতে প্রায় ৩০ ধরনের ফসলের চাষ হয়। এখানে যে কৃষক ৩০ শতাংশ জমিতে বছরে দুইবার ফসল ফলানোর সুযোগ পান, তার দারিদ্র্য বলে কিছু থাকে না। কারণ চর হচ্ছে শস্যভাণ্ডার। পলি মাটির জন্য এখানে জমিতে বেশি ফসল ফলে।

সীমিত সম্পদের তুলনায় অধিক জনসংখ্যার এই দেশকে নিকট ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় যে চরাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে, এই কথা এখনই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়। কিন্তু যে মানুষগুলো চরাঞ্চলের চরম আবহাওয়া সহ্য করে আমাদের জন্য খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন, তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না।

তবে বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হচ্ছে তার ফল চরাঞ্চলের মানুষও ভোগ করছে। কিন্তু সঠিক লাভ ওঠাতে পারছে না শুধু অবকাঠামোর দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে। যে খরা-বন্যা সহিষ্ণু ফসল কিংবা অধিক ফলনশীল জাতের ফসল তারা চাষ করছেন, তা সঠিক দামে বিক্রি করতে পারেন না শুধু এলাকার দুর্গমতার কারণে।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার মাত্র কয়েকটি চরে উৎপাদিত মরিচ জেলার চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও যাচ্ছে। বর্তমানে জেলার চরগুলোতে যে পরিমাণ মিষ্টি কুমড়া চাষ হচ্ছে, তা দিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব। দেশের স্থলভাগে যখন পাট, ভুট্টা, হরেক রকমের ডাল এবং গমের চাষ কমে যাচ্ছে, তখন চরাঞ্চলে এসব ফসলের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

চরাঞ্চলের সমস্যা

মূলত চারটি সমস্যায় এসব এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন আটকে আছে। তা হলো- অবকাঠামো, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা।

চরে অবকাঠামোর কিছুটা উন্নয়ন হলেও প্রবল নদীভাঙনে তার চিহ্ন লক্ষ্য করা যায় না। প্রতি বছর নদীভাঙন, ভূমিক্ষয়, বন্যার কারণে মানুষের শেষ আশ্রায়স্থল, স্কুল কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। যার কারণে এখানে উৎপাদিত ফসল কৃষক সংরক্ষণ করতে পারে না।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে চর এলাকার ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারে না। মেয়েদের বাল্যবিয়ে হয়ে যায়, আর ছেলেরা জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ে। যারা সর্বশেষ টিকে থাকে তাদের ভাগ্যে জোটে না ভালো শিক্ষা। চরাঞ্চলে যাতায়াত ও তদারকি না করার কারণে অনেক শিক্ষক তার কর্মস্থলে না গিয়ে প্রক্সি দিয়ে পাঠদান করান। অনেকেই মাসে দুই একবার গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে আসেন। সব প্রতিকূলতা পার করে যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন তারা আর চরে ফিরে যান না। এমনকি চরের শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে কখনো ভাবেনও না। এসব মিলিয়ে চরাঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হয় না।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার টেংরামারি চরের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের চরে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেকেই স্কুলে যায় না। তিনভাগের এক ভাগ শিক্ষকও স্কুলে আসে না। অনেকেই বদলি শিক্ষক হিসেবে এলাকার বেকার শিক্ষিত যুবক দিয়ে ক্লাস নেন।

ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২৯টি। তার মধ্যে চর এলাকায় আছে ৭৭টি। এরমধ্যে গত দুই বছরে ভাঙনের শিকার হয়েছে সাতটি স্কুল। বন্যার সময় অনেক বছর দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত এসব স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কোনো সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। এসব স্কুলের গড় শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০০ জন। সে হিসাবে চরের স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা হয় প্রায় আট হাজার। চরের ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে আর হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারে না।

ফুলছড়ি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস জানায়, এই উপজেলায় চর এলাকাগুলোতে কোনো কলেজ নেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ছয়টি এবং উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে চারটি। এর পাশাপাশি দাখিল মাদরাসা আছে দুটি। চর এলাকায় মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে পারে না প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এখনো গাইবান্ধার চর এলাকার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারে না। এর পিছনে দারিদ্র্য, চর এলাকার অভিভাবকদের অসচেতনতা, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বাল্যবিয়েকে দায়ী করেছেন অনেকেই।

গাইবান্ধার তিস্তা, ব্রাহ্মপুত্র যমুনার চরাঞ্চলের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে আর পড়াশোনা করে না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, বাড়ির কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অন্য চরে বা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে খরচ যায় অনেক বেড়ে। প্রতিদিন অভিভাবকদের সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থী প্রতি দিতে হয় ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত। যেসব সচেতন অভিভাবকদের সামর্থ্য আছে, কেবল তারাই সন্তানদের শহরে আবাসিক হোস্টেল বা মেসে রেখে পড়াশুনা করাতে পারেন।

ভাগ্য না বদলানো চরবাসীর দুঃখগাথা

এছাড়া চরাঞ্চলের মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পান বটে, তবে সেটাও পর্যাপ্ত নয়। সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক ও কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সেবা পান, কিন্তু সেটাও নিয়মিত না। ফলে হঠাৎ করে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে এক প্রকার যুদ্ধ করতে হয় পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে। এ অঞ্চলের শিশুসহ বয়স্ক মানুষদের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কড়াইবাড়ী চরের গৃহবধূ কোহিনুর বেগম বলেন, চরের চিকিৎসা সেবার একেবারে বাজে অবস্থা। এখানে কেউ অসুস্থ হলে ভালো মানের কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। বন্যার সময় নৌকা আর শুকনো মৌসুমে বালুর মধ্যে চৌকিতে করে দুইজন কাঁধে করে নিয়ে যেতে হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ১৯টি, যার মধ্যে ১২টি চরাঞ্চলের মধ্যে। এই ১২টির মধ্যে গত দুই-তিন বছরের বন্যায় ভেঙে গেছে পাঁচটি। যেগুলো এখন অস্থায়ী টিনের ঘরে রূপ নিয়েছে। চরবাসীদের দাবি, এখানে সিএইচসিপি নিয়মিত সেবা দিতে আসেন না। তারা প্রায় সবাই বসবাস করেন শহরে। নিজ নিজ কর্মস্থলে কেউ যান সপ্তাহে এক দিন, কেউ দুই দিন, কেউবা তিন দিন। অথচ তাদের সেখানে প্রতিদিন যাওয়ার কথা। এই স্বাস্থ্যকর্মীরা যে প্রতিদিন যান না, সেই বিষয়টি জানেন না উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা সিভিল সার্জন নিজেও।

গাইবান্ধা সিভিল সার্জন ডা. কানিজ সাবিহা চরাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবার অনুন্নত মানের দায় স্বীকার করে বলেন, এসব অঞ্চলে সেবা দেওয়াটা অনেক কঠিন। কারণ এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। সব সময় নৌকা পাওয়া যায় না। কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করলে তা ভাঙনের শিকার হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরা ঠিকমতো সেবা দেয় কি না সেটা তদারকি করাও সম্ভব হয় না।

চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো খারাপ যে কেউ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাকে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শহরের কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। বেশি সমস্যা হয় প্রসূতিদের চিকিৎসা পেতে। গাইবান্ধা সদর এবং ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে যারা বাস করেন তারা জানিয়েছেন, মাত্র শতকরা পাঁচ শতাংশ নারীকে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়, বাকি ৯৫ শতাংশের ক্ষেত্রে বাড়িতে বাচ্চা প্রসব হয়। জরুরি অবস্থায় অসুস্থ রোগীকে নৌকায় করে কাছাকাছি চরের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সবসময় নৌকাও পাওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে সমস্যা আরও প্রকট হয়। অন্য চরে যেতে হলে হেঁটে যেতে হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌকা নিয়ে নদী পার হওয়া যায় না।

সিধাই চরের আব্দুর রহিম বলেন, প্রতি বছর বন্যার কারণে চরে পলি পড়ে। এই পলি মাটিতে আবাদ ভালো হয়। কিন্তু ফসল উৎপাদন কিংবা পোকা মাকড় থেকে রক্ষায় কৃষি অফিস থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাই না। এখানে যারা মেম্বার-চেয়ারম্যান দলের নেতা কৃষি অফিসের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারনের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, বর্তমানে চরাঞ্চলে ভুট্টা, মরিচ ও মিষ্টি কুড়মা সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হচ্ছে। তবে এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনে ফসলের আবাদ করছেন কৃষকরা।

চরে জীবনমান উন্নয়নে করণীয়

গাইবান্ধা চরাঞ্চল নিয়ে কমপক্ষে ছোট বড় ৩০ এর অধিক বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) ভাগ্যের উন্নতি হলেও চরের মানুষদের ভাগ্য বদলায় না।

চরাঞ্চলের উন্নয়ন ঘিরে যদি মেগা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায়, যদি নদী শাসনের মাধ্যমে চরগুলোতে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো যায়, সেই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা যায়, তাহলে চরগুলো পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য-প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটবে। স্থায়ী কিছু বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করে কমিউনিটি ভিত্তিক ফসল চাষ, বিক্রি এবং চিকিৎসা সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

গাইবান্ধা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকারে চরের মানুষ পিছিয়ে রয়েছেন। চরের উৎপাদিত পণ্যগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়মিত সরকারিভাবে তদারকি করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীত্বে চরের সংকট, সম্ভাবনা ও সক্ষমতাকে দেখতে হবে।

এ এইচ শামীম/এফএ/জিকেএস

Read Entire Article