ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা আমাদের করণীয়

3 hours ago 5

গত ছ’মাস ধরেই ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা চলছে। আমাদের সরকার বারবার এসবের প্রতিবাদ করলেও তাদের থামানো যাচ্ছেনা। অভিযোগ উঠেছে, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন সেটি অত্যন্ত ‘সুপরিকল্পিত’। বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় কিছু মিডিয়া বাংলাদেশকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, ‘রিপাবলিক বাংলা’ এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। চ্যানেলটি অনবরত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।

একই সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমস, জি নিউজ, লাইভ মিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, রিপাবলিক, আজতাক, এবিপি আনন্দসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। এসব চ্যানেলে গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে করা বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। এসব গুজব ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়ানো হচ্ছে।

অনবরত বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজবের জন্ম দিয়ে চলেছেন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলার সিনিয়র এডিটর ও হেড অব ইনপুট হিসেবে কর্মরত ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ। শুধু তিনি নন, গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম এক হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশটির এতোগুলো মিডিয়ার প্রপাগান্ডা আমাদের ভাবাচ্ছে। সে দেশের লাখ লাখ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মিনিটে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। নিজ দেশের ভিডিওকে বাংলাদেশের ঘটনা বলে প্রচার করছে। তাই ইরাকের ঘটনা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে আরো সচেতন এবং সতর্ক থাকতে হবে।

আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ‘রিউমার স্ক্যানার’ ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে অসত্য ও ভুয়া খবর প্রচারের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। যেখানে গত আগস্ট মাসের ১২ তারিখ থেকে ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত ১৩টি বিষয়ে ৪৯টি গুজব ছড়ানোর তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

রিউমার স্ক্যানার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে একের পর এক গুজব। রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে, রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া গেছে। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক পাঁচটি গুজব প্রচার করেছে। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে হিন্দুস্থান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট। তারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি করে গুজব প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ ও আজতক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।

আমরা আরো লক্ষ্য করলাম সংস্থাটি বলেছে, এসব গুজবের মধ্যে ছিল— শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিও হিন্দু ব্যক্তি হিসেবে প্রচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার গুজব, বাংলাদেশে মুসলমানদের হামলায় মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর— এমন দাবি প্রতিষ্ঠা করতে ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে— যুক্তরাজ্যের এমন ভ্রমণ সতর্কতা জারির মতো বিভ্রান্তিকর খবর।

১৯৭১ সালের পর গত ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম পণ্যবোঝাই জাহাজকে পুরোদস্তুর অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বানিয়ে দেয়। রঙ্গরসে পটু ভারতীয় সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন কল্পকাহিনি ঢালাওভাবে প্রচার করেন।
নিউজ ১৮ বাংলা নামের একটি ভারতীয় গণমাধ্যম এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল— ‘পাকিস্তান থেকে অস্ত্র কিনছে বাংলাদেশ! ৫২ বছর পর অস্ত্রবোঝাই জাহাজ পৌঁছাল চট্টগ্রামে’। এ বিষয়ে আজতাক নামের আরেকটি গণমাধ্যমের করা রিপোর্টের শিরোনাম দেওয়া হয়, “বাংলাদেশে আসা পাক জাহাজ দেখতে গিয়ে ‘গুম’ কয়েকজন অফিসার! অস্ত্র ছিল?”

রিপাবলিক বাংলার রিপোর্টের শিরোনামে বলা হয়, ‘এক জাহাজ অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ? মৌলবাদের ষোলকলা পূর্ণ হলো বাংলাদেশে?’

কলকাতা নিউজের রিপোর্টের শিরোনামে বলা হয়, ‘পাক-বাংলাদেশের নয়া ছক! করাচি থেকে চট্টগ্রামে পণ্যবাহী জাহাজের আড়ালে অস্ত্র’। শুধু জাহাজ আসার খবর নয় বরং জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান, পালিয়েছেন ড. ইউনূস, মৌলবাদীদের ভয়ংকর রূপ, সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ অসংখ্য বিষয়ে অসত্য তথ্যের সমন্বয়ে মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো।

এখানে একটি বিষয় স্মরণ করতে হয়, ইরাক আক্রমণের আগে আন্তর্জাতিক কিছু গণমাধ্যমে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল। সেইসব গুজবে বলা হয়েছিল, ইরাকে ভয়ানক রকমের রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ রয়েছে। গ্যাস প্রয়োগ করে লাখো কুর্তি জাতি গোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়েছে। ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সেইসব খবর আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। যুদ্ধ শেষে, ইরাক ধ্বংস হবার পর আমরা কি দেখতে পেলাম তা সবারই জানা।
তাই প্রতিবেশী দেশটির এতোগুলো মিডিয়ার প্রপাগান্ডা আমাদের ভাবাচ্ছে। সে দেশের লাখ লাখ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মিনিটে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। নিজ দেশের ভিডিওকে বাংলাদেশের ঘটনা বলে প্রচার করছে। তাই ইরাকের ঘটনা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে আরো সচেতন এবং সতর্ক থাকতে হবে।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনি রং মাখিয়ে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে কোনো কমতি রাখেনি ভারতীয় গণমাধ্যম। যেমন, ‘মহিলারা শাখা-সিঁদুর পরে বেরোতে পারছে না, হিন্দু বুঝে গেলে সমস্যা বাংলাদেশে’— এমন শিরোনামে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম এবিপি আনন্দ। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নামের একটি মিডিয়ায় সংবাদ হয়েছে, ‘চার মাসে ২০০-এর বেশি হামলা, বিরাট সংকটে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে ইসকনের’।

তবে, এমন কোনো ঘটনার কথা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া সনাতনী মহিলারা শাখা-সিঁদুর পরে বাইরে বেরোতে পারছেন না— এমন অভিযোগও দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন করেনি। উল্টো ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করতে ভারতে যাওয়া হিন্দু নারী ও পর্যটকদের ‘জোর করে’ নির্যাতন করা হচ্ছে— এমন বক্তব্য নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বলেছে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কথা ভারত বলছে সেটি সত্য নয়। ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে শতভাগ মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে ।

আমরা জানি,বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার সরকারের এমপি, মন্ত্রীসহ কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। কারও কারও ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মুসলিম কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি যেমন ভাঙচুর করা হয়েছে, তাদের হিন্দু নেতা-কর্মীর বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে। হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে। ধর্মের কারণে হয়নি। বিষয়টি আমরা সবাই জানি।

আওয়ামী লীগের শাসনকালের দেড় দশকেও এমন দু’- চারটে ঘটনা ঘটে। এমন ছোট ছোট দুই একটি ঘটনা আছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন আসে ভারতীয় গণমাধ্যম কী প্রচার করছে? তারা বলছে শত শত হিন্দুকে হত্যা করা হচ্ছে। যার কোনো সত্যতা নেই। তারা বলছে হিন্দুরা খুব খারাপ আছে। এর কোনো সত্যতা নেই। ভারতীয় গণমাধ্যম সবচেয়ে বড় রকমের অপরাধ করছে। তারা এখনকার দুই-একজন হিন্দুর বক্তব্য প্রচার করে ৫ আগস্টের আগের ভিডিও— যেখানে শেখ হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছিল সেইসব ভিডিও যুক্ত করে দিচ্ছে।

আনন্দবাজারের মতো পত্রিকা এ রকম কাজ করছে। এর মানে তারা শতভাগ প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।

এছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যার পর ভারতীয় গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করলো- তিনি চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী, এ জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তিনি চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী নন। বাংলাদেশকে অস্থির করতে ভারতীয় গণমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। এটা আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি।এখন প্রয়োজন আমাদের সতর্ক-সচেতন থাকা।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article