ভাড়ায় চলছে শেকৃবি টিএসসি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সীমিত

1 month ago 7

সাইদ আহম্মদ, শেকৃবি

সামাজিক কর্মকাণ্ড প্রসারিত করতে এবং ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে মেলবন্ধ বাড়াতে প্রায় ৩২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) নির্মাণ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রতিষ্ঠার চার বছর পার হলেও তা পরিপূর্ণভাবে উন্মুক্ত হয়নি। তবে ভাড়ায় চলছে বিয়েসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দ্রুত টিএসসি উন্মুক্ত করে, শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনুষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, টিএসসি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানান সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে, ক্লাবগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে বড় অনুষ্ঠান ছাড়া তারা এ সুযোগ পাচ্ছেন না।

তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্লাবগুলোর দু-একটি বড় অনুষ্ঠান ছাড়া সবসময় টিএসসি বন্ধ থাকলেও বহিরাগতরা ভাড়া দিলেই খুলছে টিএসসির মেইন গেট। বহিরাগতরা এসে নিজেদের মতো চলছে আবার কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ছে অসামাজিক কাজেও, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও হুমকির মুখে ফেলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত শেকৃবির ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) মোট ২৪টি অনুষ্ঠান হয়েছে। যার ১৩টি বিয়েসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠান, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।

ভাড়ায় চলছে শেকৃবি টিএসসি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সীমিত

নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর টিএসসি প্রথম ব্যবহৃত হয় ২০২১ সালে। এরপরই টিএসসি উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও লোকবল সংকট, অবকাঠামোগত সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে উন্মুক্ত করেনি সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে সরকার পতনের পর বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো টিএসসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিপূর্ণ উন্মুক্ত করার দাবি জানালেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

আমরা চাই, বর্তমান প্রশাসন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিক, ক্লাবগুলোর জন্য রুম বরাদ্দ করুক এবং টিএসসি পুরোপুরি শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখুক। এরপর অতিরিক্ত সুবিধা থাকলে বাইরের অনুষ্ঠান হতে পারে। - শিক্ষার্থী নাহিদ মাহমুদ

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী নাহিদ মাহমুদ সৌরভ বলেন, ‘আমি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে বলতে চাই, আমাদের টিএসসি আসলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র নয় বরং একটা কমিউনিটি সেন্টার হয়ে গেছে। বিয়ে, পুনর্মিলনীর মতো বাইরের অনুষ্ঠান হয় সেখানে অথচ আমাদের ক্লাবগুলোর জন্য কোনো রুম বরাদ্দ নেই—বরং রুম ভাড়া দেওয়া হয়, যা একেবারেই শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। আমরা চাই, বর্তমান প্রশাসন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিক, ক্লাবগুলোর জন্য রুম বরাদ্দ করুক এবং টিএসসি পুরোপুরি শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখুক। এরপর অতিরিক্ত সুবিধা থাকলে বাইরের অনুষ্ঠান হতে পারে, তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব।’

আরেক শিক্ষার্থী শাহিন আহমেদ বলেন, টিএসসি ভাড়া দেওয়া খারাপ কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া আয় ও ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সম্পর্ক গড়ার জন্য ইতিবাচক। তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে—অনুষ্ঠান শেষে অপরিচ্ছন্নতা, শিক্ষার পরিবেশে ব্যাঘাত এবং ছাত্রদের জন্য অসুবিধা তৈরি হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশে ব্যাঘাত ঘটে। কারণ আমাদের ছেলেদের হলগুলো টিএসসি সংলগ্ন। আমি চাই টিএসসি সবসময় উন্মুক্ত রাখা হোক এবং ক্লাবগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হোক; যেন একটি ইতিবাচক শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হয়।

ভাড়ায় চলছে শেকৃবি টিএসসি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সীমিত

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুয়াদ হাসান বলেন, আমাদের টিএসসির সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০২১ সালে কিন্তু এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। অথচ এই টিএসসির ভেতরে বাইরের বিভিন্ন প্রোগ্রাম হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে সপ্তাহে একটি ওয়ার্কশপ কিংবা বড় মাপে সেমিনার হওয়ার কথা ছিল, যেখানে অংশগ্রহণের সুযোগ শিক্ষার্থীরা পাবে। কিন্তু টিএসসির এমন ভুল ব্যবহার হতাশার বহির্প্রাকাশ ঘটাতে বাধ্য করে।

শেকৃবি ছাত্রদল সভাপতি আহমেদুল কবির তাপস বলেন, ক্লাবগুলোর নেতাকর্মীদের কথা শুনেই আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি তুলেছিলাম। তবে টিএসসির গঠনগত সমস্যার কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের জানালে আমরা ক্লাবগুলোকে শেয়ারে রুম দেওয়ার কথা বলি। তবে সেই সময় প্রশাসন একমাস সময় চান কিন্তু এখন দেড়-দুই মাস পার হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজের জন্য নির্মিত স্থানে ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, ক্যাম্পাসের প্রতিটি রেজিস্টার্ড সংগঠনের জন্য নির্ধারিত রুম বরাদ্দ থাকা উচিত। - শিবির সভাপতি আবুল হাসান

এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবির সভাপতি আবুল হাসান বলেন, আমরা খেয়াল করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এখন বহিরাগতদের আয়োজনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা অন্যতম দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের জন্য নির্মিত এ স্থানে আজ ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, ক্যাম্পাসের প্রতিটি রেজিস্টার্ড সংগঠনের জন্য নির্ধারিত রুম বরাদ্দ থাকা উচিত। পাশাপাশি ক্লাব ও সংগঠনগুলো যেন নিয়মিত সভা-সেমিনার, আলোচনা ও সৃজনশীল চর্চা করতে পারে—এটি নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব।

ভাড়ায় চলছে শেকৃবি টিএসসি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সীমিত

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংগঠনগুলো রুম না পাওয়ায় অনেকে কার্যক্রম চালাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো শহীদ মিনার, ক্যাফেটেরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে। এতে সংগঠনগুলোর কার্যক্রম না চাইলে সীমিত করে আনতে হচ্ছে বলে দাবি নেতাদের।

শেকৃবি বাঁধন সভাপতি আফিকুল ইসলাম রাহি বলেন, আমাদের প্রতি মাসে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু রি-এজেন্ট সংরক্ষণের মতো একটি ফ্রিজের ব্যবস্থা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি কেবল একটি স্থায়ী অফিস না থাকায়। তাছাড়া বাঁধনকর্মীদের নিয়ে মাসিক বৈঠক করতে হয় খোলা জায়গায় এবং সেখানে উপস্থিত থাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। দুই মাস আগে টিএসসির পরিচালক প্রফেসর মো. আখতার হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জানানো হয়, বর্তমান অবকাঠামোতে সর্বোচ্চ তিন-চারটি ক্লাবকে অফিস বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব।

শেকৃবি সাহিত্য সংসদের সভাপতি মেহেদী আকাশ বলেন, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য সভা আয়োজন করে, যেখানে সাহিত্য ও সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি তারা কবিতা, গান, নাটক ও নাচসহ বাঙালি লোকসংস্কৃতি চর্চাও করে। খোলা আকাশের নিচে এসব কার্যক্রম পরিচালনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কোলাহলের কারণে নানান সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া সাহিত্য সংসদের নিজস্ব ৪০০ বইয়ের একটি লাইব্রেরিও আছে, কিন্তু নির্দিষ্ট কক্ষ না থাকায় তা সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সভা ও লাইব্রেরির জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ এবং ক্লাবগুলোর জন্য টিএসসি খুলে দেওয়া জরুরি।

ভাড়ায় চলছে শেকৃবি টিএসসি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সীমিত

টিএসসি কর্তৃপক্ষ বলছেন, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণেই সংগঠনগুলোকে কক্ষ বরাদ্দ দিতে পারছেন না তারা। এছাড়া টিএসসিতে প্রাপ্ত ভাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের একটি উৎস বলে জানান।

একটা টিএসসি যেভাবে গড়ে ওঠার কথা আমাদেরটা সেভাবে তৈরি করা হয়নি এবং আমরা চাইলেও এটাকে আবার ভেঙে নতুনভাবে করতে পারবো না। তবে কিছু কাজ হাতে নিয়েছি। - প্রফেসর মো. আখতার হোসাইন

টিএসসি পরিচালক প্রফেসর মো. আখতার হোসাইন বলেন, একটা টিএসসি যেভাবে গড়ে ওঠার কথা এটা সেভাবে তৈরি করা হয়নি এবং আমরা চাইলেও এটাকে আবার ভেঙে নতুনভাবে করতে পারবো না। তবে আমরা কিছু কাজ হাতে নিয়েছি যেমন নিচে নামাজের জায়গা তৈরি করা, নিচের ফ্লোর থেকে ওপরের ফ্লোরগুলোতে যাওয়ার রাস্তায় গেট লাগানো। আশা করি কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন হবে। যেহেতু আমরা সব সংগঠনকে আলাদা আলাদা রুম দিতে পারছি না তাই নিচের জায়গাটি করপোরেট ব্যাংকের মতো ভাগ করে সংগঠনগুলোকে দেওয়ার চিন্তাভাবনাও করছি এবং ভিসি স্যার এটা পরিদর্শন করে গেছেন।

ভাড়ায় চলছে শেকৃবি টিএসসি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সীমিত

লোকবল সংকট রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি সামনে নিয়োগ হলে লোকবল সংকট আর থাকবে না।

এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, টিএসসির রিস্ট্রাকচার করার জন্য আমরা ডিজাইনারের সঙ্গে কথা বলেছি; তবে এখানে বেশ বড় একটা বাজেটের দরকার আছে এবং সেটার জন্যই আটকে আছি।

এমআরএম/এমএফএ/এএসএম

Read Entire Article