ভুয়া প্রকল্পের ছড়াছড়ি, দুই ফুটবলের দাম এক লাখ টাকা

2 weeks ago 16

২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি ও রাজস্বের অর্থায়নে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় অন্তত নয়টি প্রকল্পে ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা পরিষদ। তবে নয়টি প্রকল্পের মধ্যে ছয়টিরই কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকি তিনটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও দায়িত্বপ্রাপ্তরা পাননি কোনো বরাদ্দের টাকা বা সমমূল্যের মালামাল। ব্যয় হয়েছে শুধু কাগজে কলমে।

নামে বেনামে প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের এমন অনিয়ম দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে সরেজমিন অনুসন্ধানে। উপজেলা প্রশাসনের তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য চিত্র।

স্থানীয়দের অভিযোগ, তৎকালীন সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এমন অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে। যার মূলহোতা সদ্য বাতিল হওয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।

ভুয়া প্রকল্পের ছড়াছড়ি, দুই ফুটবলের দাম এক লাখ টাকা

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপির অর্থায়নে যদুবয়রা ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের সাথীসংঘ পাঠাগার নামক প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় জেলা পরিষদ। তবে সরেজমিন গিয়ে কোনো অস্তিত্বই মেলেনি এই প্রতিষ্ঠানের। সেখানে রয়েছে একটি চায়ের দোকান।

এ সময় মৃত রহিম সরদারের ছেলে ও সাথীসংঘ পাঠাগারের দাতা সদস্য মান্নান সরদার (৬০) বলেন, আমার বাবা সাথীসংঘের নামে পাঁচ কাঠা (প্রায় সাড়ে আট শতাংশ) জমি দিয়েছিল আনুমানিক ১৯৭৬ সালে। তবে প্রায় ২২ বছর আগে থেকেই এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। এখন পাঠাগারের স্থানে চায়ের দোকান বসিয়েছি।

একই অর্থবছরে যদুবয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল, ভলিবল ও খেলার সামগ্রী বাবদ রাজস্বের অর্থায়নে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় জেলা পরিষদ। এক লাখ টাকার বিপরীতে বিদ্যালয়ে মাত্র দুইটি ফুটবল দিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান।

ভুয়া প্রকল্পের ছড়াছড়ি, দুই ফুটবলের দাম এক লাখ টাকা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘বরাদ্দ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছেন ইউএনও। শুনেছি এক লাখ টাকা বরাদ্দ। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব মাত্র দুটি ফুটবল দিয়েছেন বিদ্যালয়ে।’

তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলেন, কিছু খেলার সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। অর্থবছরের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আরও খেলার সামগ্রী কিনে বিদ্যালয়ে প্রদান করা হবে।

যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পেছনে রয়েছে প্রত্যাশা ক্লাব ও পাঠাগার নামক একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবুও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন বাবদ এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় জেলা পরিষদ।

সরেজমিন দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনশেডে আধাপাকা ঘরের ক্লাবটির দরজায় ঝুলছে তালা। খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা ঘরের ভেতরে একটি করে টেবিল, চেয়ার ও বেঞ্চ রয়েছে।

এ সময় যদুবয়রা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও চৌরঙ্গী মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলাম আসাদ বলেন, সরকার প্রকল্প দেয় উন্নয়নের জন্য। কিন্তু সরকার দলীয় অসাধু নেতাকর্মীরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে অর্থ লোপাট করে। এদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার দাবি তার।

ভুয়া প্রকল্পের ছড়াছড়ি, দুই ফুটবলের দাম এক লাখ টাকা

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে আরও জানা গেছে, একই অর্থবছরে এডিপির অর্থায়নে উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের গোবরা চাঁদপুর শেখ রাসেল স্পোর্টিং ক্লাব উন্নয়নে এক লাখ টাকা, শিলাইদহ ইউনিয়নের দারুস ছালাম দাখিল মাদরাসা উন্নয়নে এক লাখ টাকা, রাজস্বের অর্থায়নে চাঁদুপুর শেখ কামাল যুবসংঘ ক্লাব উন্নয়নে এক লাখ টাকা, জগন্নাথপুর ইউনিয়নের মহেন্দ্রপুর ক্লাব উন্নয়নে এক লাখ ৫০ হাজার, চাপড়া ইউনিয়নের বাঁধবাজার শেখ রাসেল স্মৃতি পাঠাগার উন্নয়নে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় জেলা পরিষদ। তবে সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া একই অর্থবছরে উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা যুব ও ক্রীড়া সংঘের আসবাবপত্র উন্নয়ন বাবদ এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত পায়নি বরাদ্দকৃত অর্থ বা মালামাল। কে কিভাবে টাকা তুলেছেন তাও জানেন না প্রতিষ্ঠানটির কেউ।

ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাবীব চৌহান।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় জেলা পরিষদের বরাদ্দকৃত প্রকল্প যাচাই বাছাই করে পাঁচটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার যেগুলোর অস্তিত্ব আছে, সেগুলোতে বরাদ্দকৃত অর্থ বা মালামাল পাইনি। এই মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনটি কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেওয়া হয়েছে।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, প্রকল্পগুলো যাচাই-বাচাইয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। দুর্নীতি অনিয়ামের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এফএ/এমএস

Read Entire Article