কুমিল্লার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম অভিমুখী প্রবেশপথ পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডের বিপজ্জনক ইউটার্নের সর্বশেষ প্রাণহানি একই পরিবারের চারজন- বাবা, মা আর দুই ভাই। এমন নির্মম মৃত্যুর দায় নেবে কে।
মহাসড়কের এমন ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল নির্বিঘ্ন করতে দেরিতে হলেও ২০২২ সালের আক্টোবরে শুরু হয় পদুয়ার বাজার ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্প। শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জুনে, যা এখন মেয়াদ ফুরিয়ে চলছে আরও দু’মাস। কাজ হয়েছে মাত্র ৪০ ভাগ।
চট্টগ্রামগামী সড়কের ভূমি অধিগ্রহণে থমকে আছে নির্মাণ কাজ। নির্মাণাধীন ইউলুপ প্রকল্পের ধীর গতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় অধিবাসী, মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকরা।
সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা কালবেলাকে বলেন, মহাসড়কের উত্তর পাশে জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে ইউলুপ নির্মাণের কাজ আটকে আছে। আমাদেরকে যদি এক মাসের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়া যায় তাহলে এক বছরের মধ্যে নির্মাণাধীন ইউলুপ নির্মাণের কাজ শেষ করে দেয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক। একটি উল্টোমুখি বাসের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার কালবেলাকে বলেন, পদুয়ার বাজার ইউলুপ নির্মাণের জন্য মহাসড়কের উত্তর পার্শ্বে ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে ৫৭টি আপত্তি পাওয়া গিয়েছে। সেখানকার জমির মালিকদের এই আপত্তি নিষ্পত্তি করতে আমরা শুনানি চালু রেখেছি। এত বেশিই আপত্তি শুনানি ও জটিলতা নিরসনে সময় লাগছে। শুনানিগুলো সম্পন্ন হলে আমরা জমি অধিগ্রহণ করে দিতে পারব।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, প্রস্তাবিত অধিগ্রহণের জন্য যেন সাধারণ মানুষ কমক্ষতির শিকার হয় সে বিষয়টি খেয়াল রেখে আমাদের এগোতে হচ্ছে। তাই আপত্তি শুনানিতে সময় লাগছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে শুনানি শেষ করার।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিক এম ফিরোজ মিয়া জানান, ইউলুপ নির্মাণ হলে শুক্রবারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা- প্রাইভেটকার ও লরির সংঘর্ষটা হতো না। কারণ লরি যেত নিচে দিয়ে আর প্রাইভেটকার যেত উপর দিয়ে। ইউলুপসহ ৩টি আন্ডারপাস করার কাজ শুরু হয় বিগত সরকারের শেষ সময়ে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বলছে ইউলুপের ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আর আন্ডারপাসের মাত্র ২৫ ভাগ কাজ হয়েছে। এখন কাজে গতি নেই। থেমে আছে বলা চলে। তার দাবি, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ইউটার্ন এলাকায় কমবে যানজট ও দুর্ঘটনা।
সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আদনান বিন হাসান কালবেলাকে জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে তহবিল ঘাটতি নেই। তবে ভূমি অধিগ্রহণে বাড়তি অর্থ লাগবে। প্রকল্পটি ৫৬৮ কোটি টাকার। এতে কুমিল্লা শহর থেকে চট্টগ্রাম ও ঢাকা অভিমুখে চলাচল ও প্রবেশ ও কুমিল্লা- নোয়াখালী- চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের সাথে ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল নির্বিঘ্ন হবে। এতে ঢাকা- চট্টগ্রাম সাথে কুমিল্লা, ফেনি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষীপুরের সড়ক যোগাযোগ সহজ, ঝুঁকিমুক্ত ও নিরবচ্ছিন্ন হবে, সময়ও বাঁচবে।
তিনি আরও জানান, একই সঙ্গে অধিক দুর্ঘটনা প্রবণ সংলগ্ন তিনটি স্থান সদর দক্ষিণ উপজেলা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশ পথ বেলতলী ও পদুয়ার বাজার এলাকায় তিনটি আন্ডারপাস হবে। এর মধ্যে বেলতলীরটা অনেকদূর এগিয়েছে, সদর দক্ষিণ উপজেলা এলাকারটা মাত্র শুরু হয়েছে আর পদুয়ার বাজারের আন্ডার পাসের নির্মাণ কাজ এখনও শুরু হয়নি।
এদিকে শুক্রবার দুপুরের ওই দুর্ঘটনার পর শনিবার পদুয়ার বাজারের বিপজ্জনক ইউটার্ন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইউটার্নটি সোয়া এক কিলোমিটার দূরে সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সামনে দয়াপুরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মহাসড়কের ওই জায়গা আরও সরু। এতে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। রোববার বিকেলে বিআরটিসি বাস ইউটার্ন নেওয়ার সময় দ্রুত গতিতে এসে ধাক্কা দেয় ট্রাক। অল্পের জন্য বেঁচে যায় অনেক যাত্রী।
পদুয়ার বাজার ইউটার্ন শিগগিরই নতুন ভাবে ৫০০ মিটার চট্টগ্রামের (পূর্ব) দিকে স্থানান্তর করা হবে। রোববার জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার। পদুয়ার বাজার ইউটার্ন শিগগিরই একটু পূর্বদিকে স্থানান্তর করা হবে। ওই স্থানে মাঝখানে মিডিয়ান দিয়ে নিরাপদ ইউটার্ন গড়ে তোলার (নির্মাণ) বিষয়ে সড়ক নিরাপত্তা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে হোটেল নূরজাহানের সামনে অবৈধ বাস কাউন্টার তুলে দেওয়া হবে। মহাসড়কে উলটো পথে যানচলাচলে জরিমানাসহ আইনের কঠোর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার খায়রুল আলম জানান, রোববার সকালে জেলা প্রশাসকের অফিসে পুলিশ, সওজ, হাইওয়ে, সেনা সবার সমন্বয়ে সভায় হয়েছে। সরিয়ে নেওয়া ইউটার্নের জায়গায় সরু যতটুকু আছে প্রশস্ত করে নেওয়াসহ অনেকগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা বাস্তবতায়ন করে নেয়া হবে। তিনি আরও জানান, একটু দূরে ইউটার্ন নিলে ব্যস্ততা ও যানজটের ঝুঁকি কমে আসে। এতে থ্রি হুইলারের ঝামেলাও কম থাকবে।
শুক্রবার (২২ আগস্ট) দুপুরে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড ইউটার্নে হানিফ পরিবহনের একটি বাস উলটো পথে আসায় তাকে সাইড দিয়ে গিয়ে দ্রুত গতিতে আসা সিমেন্টবোঝাই একটি লরি রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকা প্রাইভেটকারের ওপর উল্টে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের বাবা-মা ও দুই ছেলে নিহত হয়।
নিহতরা হলেন- কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের মোহাম্মদ ওমর আলী (৮০), তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৬৫), বড় ছেলে ব্যাংক এশিয়ার কর্মকর্তা মো. আবুল হাশেম (৫০) ও ছোট ছেলে আবুল কাশেম (৪৫)। প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন বড় ছেলে আবুল হাশেম।