ভূমিকম্প: সঠিক পূর্বপ্রস্তুতি ও অভিযোজন

হাসান জাহিদ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন ভূমিকম্প হচ্ছে, যা আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এরপর দিন শনিবার (২২ নভেম্বর) আরও তিন দফা কম্পন অনুভূত হয়। এবারের ভূমিকম্পের এপিসেন্টার কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরেই হয়েছে নরসিংদীর মাধবদীতে।  রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় আবারও আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১৪ মিনিটে এ কম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর শিবপুরে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। অনেকসময় প্রতিবেশী দেশগুলোতে এপিসেন্টার হলে বাংলাদেশেও মৃদু কম্পন হয়। কিন্তু এবারের এপিসেন্টার ও আফটারশক আমাদেরকে প্রস্তুতি নেওয়ার সংকেত দিচ্ছে। রাজনীতি, নির্বাচন ও সংস্কার প্রভৃতির পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রাকৃতিক শক্তি, যথা ভূমিকম্প, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, বন্যা প্রভৃতি মোকাবেলায় এখনো পর্যন্ত শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। উপযুক্ত সরঞ্জাম, অবকাঠামো, মনিটরিং, জনবল ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা রয়েছে। যে দেশ ভৌগোলিকভাবে নাজুক, যে দেশ দুর্যো

ভূমিকম্প: সঠিক পূর্বপ্রস্তুতি ও অভিযোজন

হাসান জাহিদ

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন ভূমিকম্প হচ্ছে, যা আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এরপর দিন শনিবার (২২ নভেম্বর) আরও তিন দফা কম্পন অনুভূত হয়। এবারের ভূমিকম্পের এপিসেন্টার কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরেই হয়েছে নরসিংদীর মাধবদীতে। 

রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় আবারও আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১৪ মিনিটে এ কম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর শিবপুরে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। অনেকসময় প্রতিবেশী দেশগুলোতে এপিসেন্টার হলে বাংলাদেশেও মৃদু কম্পন হয়। কিন্তু এবারের এপিসেন্টার ও আফটারশক আমাদেরকে প্রস্তুতি নেওয়ার সংকেত দিচ্ছে।

রাজনীতি, নির্বাচন ও সংস্কার প্রভৃতির পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রাকৃতিক শক্তি, যথা ভূমিকম্প, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, বন্যা প্রভৃতি মোকাবেলায় এখনো পর্যন্ত শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। উপযুক্ত সরঞ্জাম, অবকাঠামো, মনিটরিং, জনবল ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা রয়েছে। যে দেশ ভৌগোলিকভাবে নাজুক, যে দেশ দুর্যোগপ্রধান দেশ, সেই দেশে দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত হবার প্রয়োজন রয়েছে।

শুধু ভূমিকম্পই নয়, বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় হুমকি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ নানা ক্ষতি ও কুপ্রভাবের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চল ও ভৌগোলিকভাবে নাজুক অবস্থানের দেশ ও দ্বীপ রাষ্ট্রসমূহ বিশেষভাবে বিপদাপন্ন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও বৈশ্বিক কুপ্রভাব এই দেশকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বরফ, আইস ক্যাপ ও হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফিত হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, তথা উপকূলীয় অঞ্চল চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সিংহভাগ এলাকা সমুদ্রের পানির তলে ডুবে যাবার হুমকির মুখে রয়েছে। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ না করেও বৈশ্বিক উষ্ণতার শিকার।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, এই দেশ অতিরিক্ত ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নিষিক্ত না করেও ভূমণ্ডলীয় কুপ্রভাবের শিকার হয়ে ধুঁকছে এর প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, ইকোসিস্টেম, বনাঞ্চল ও নদ-নদী, বায়ু, পানি ও মাটি। উপকূলীয় অঞ্চল বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের শিকার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের নজিরবিহীন প্রতিযোগিতা। বন উজাড়, জলাভূমি সংকোচন, নদীদূষণ ও প্রাণীর আবাসস্থল বিনাশ, পাহাড় কর্তন এবং নানাবিধ দূষণ ছড়িয়ে প্রকৃতিকে সংকুচিত করে তুলেছে। এর ফলে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।

শত বছর ধরে যা ধ্বংস হয়েছে, তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা নয়, এখন একমাত্র প্রতিকার হলো প্রকৃতি ধ্বংস প্রতিরোধ করা এবং বর্তমান বিরূপ পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়া। এরই মধ্যে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় এখন ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে। নদীভাঙনের শিকার হয়ে, বসত হারিয়ে অসংখ্য মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।

এই বিষয়ে আরো খানিকটা আলোকপাত করা হবে। বিষয়টির উত্থাপন এ কারণে যে, একটি দেশের অবকাঠামো, ইকোসিস্টেম ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকলে ভূমিকম্প বা অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে রাখা যায়। শত শত বছর ধরে জাপান ভূমিকম্পের সঙ্গেই সহাবস্থান করে টিকে আছে।

এই বছর ৩০ জুলাই শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প রাশিয়ার দূরপ্রাচ্য উপকূলের কাছে আঘাত হানে, যা সুনামি থেকে উদ্ভূত ঢেউ দিয়ে একটি মাছ ধরার বন্দরকে প্লাবিত করে, কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে এবং কিছু ভীতপ্রবণ মানুষকে ভবনত্যাগে বাধ্য করে, তবে কেবল কয়েকজন মানুষ আহত হয়। আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে তারা ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প এবং পরবর্তী ঢেউগুলোর জন্য প্রস্তুত ছিল এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাসিন্দাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। তারা কিছু এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে, তবে বড় ধরনের ক্ষতির কথা বলেনি।

‘আগুন এবং বরফের দেশ’ হিসেবে পরিচিত কামচাটকা পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি অঞ্চল। এখানে প্রায় ৩০০টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যার মধ্যে ২৯টি এখনো সক্রিয়, নাসার আর্থ অবজারভেটরি অনুযায়ী ভূমিকম্প এবং সুনামি নিয়মিতভাবে এই উপদ্বীপে আঘাত হানে, যা এমন একটি মহাসাগরীয় খাঁজের কাছে অবস্থিত যেখানে দুটি টেকটোনিক প্লেট মিলিত হয়।

৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি এতো কম হওয়ার প্রধান কারণ অঞ্চলটি জনবহুল নয়। দ্বিতীয় কারণ উন্নত দেশ বলেই তাদের ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা সুসমন্বিত ও আধুনিক। সম্প্রতি আফগানিস্তানে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি শক্তিশালী ছয় মাত্রা ভূমিকম্পে চারটি প্রদেশে অন্তত আটশ’ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা। প্রাথমিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি।

পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। রিখটার স্কেলে ছয় মাত্রার এই ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে অসংখ্য গ্রাম। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা আরো জানিয়েছে, কমপক্ষে দুই হাজার মানুষ আহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের অনেকেই দুর্গম এবং পাহাড়ি এলাকায় রয়েছেন এবং উদ্ধার কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

এই সংস্থাটি বলছে, কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষ ভূমিকম্পে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন বা অবকাঠামোও এর অন্তর্গত। অবশ্য দেশ, অঞ্চল, ভূ-অবস্থান ও ধরন এবং অবকাঠামো বিবেচনায় কম বা শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃতি, ধরন বা মাত্রা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটির ভূমিকম্প পরবর্তী ব্যবস্থাপনা দুর্বল ছিল, তদুপরি পাহাড়ি অঞ্চল হওয়াতে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে ভূমিকম্পের তোপের মুখে রয়েছে রাজধানী ও বড় বড় শহরের ভবন ও স্থাপনাগুলো। বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ জরিপে জানা যায় যে, পুরোনো ঢাকার পুরোনো ভবন ও নতুন ঢাকার হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো প্রবল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে অবশ্যি সব ভবনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, হেলে পড়বে বা ভেঙে যাবে। ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার অনেক ভবনে ফাটল ধরেছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে জানমাল রক্ষায় আমাদের কী করণীয় ও পূর্ব প্রস্তুতি, সেই দিকটিই এই লেখায় আলোকপাত করবো।

সময়মতো সঠিক প্রস্তুতির মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে বড় ধরনের ভূমিকম্পেও ক্ষতি এবং প্রাণহানি কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং দুর্বল ভবন কাঠামোর কারণে বড় কোনো ভূমিকম্প ঘটলে বিপর্যয় ভয়াবহ হতে পারে। তাই সচেতনতা, প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্র, আবাসন খাত ও জনগণ এ তিনটি স্তম্ভ শক্তিশালী হলেই আমরা ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারবো। ভূমিকম্প-সহনশীল স্থাপত্য নির্মাণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। ‘সেফটি ফার্স্ট’ নীতি অবলম্বন করে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বেসকরকারী সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি।

দেশি-বিদেশি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, স্থপতি, প্রকৌশলী, রিয়েল এস্টেট উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারক এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা বলেন, সরকারি বেসরকারি সব পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগই পারে একটি ভূমিকম্প-সহনশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর স্ট্রাকচারাল অডিট, কাজের মান কঠোরভাবে তদারকি, জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর প্রাথমিক সতর্কবার্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নাগরিকদের নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম এবং পরিবারভিত্তিক জরুরি প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।

এই লেখার শুরুর দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এজন্য যে, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকবে অ্যাডেপ্টেশন বা পরিবর্তিত বিরূপ পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। ধনী ও শক্তিধর দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাবে না, এটা এখন পরিষ্কার। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ ৩০, (১০ থেকে ২১ নভেম্বর) চলেছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রাজিলের আমাজন রেইনফরেস্ট ঘেঁষা শহর বেলেমে। উদ্দেশ্য, বিশ্বজুড়ে বনাঞ্চল নিধন বন্ধ করা।

ফলাফল আমাদের জানা আছে। শক্তিধর দেশগুলোর একই কথা। মানে সব শেয়ালের এক রা। তারা আমাদেরকে উপদেশ দিবে, তোমরা সিংক বাড়াও, আমরা অর্থ দেবো। মোটা দাগে বললে বলতে হয়, বিশ্ব ফোরামে আমাদেরকে শক্তিশালী নেগোশিয়েশনে যেতে হবে। ফান্ড আদায় করতে হবে। আর সেই ফান্ড যেন দেশের সুরক্ষায় কাজে লাগে। খেয়াল রাখতে হবে, লাভের গুড় যেন পিঁপড়েরা না খায়। সিংক তৈরির অন্যতম উপাদান বৃক্ষ রোপণ। বন সংরক্ষণ, ইকোসিস্টেম রক্ষা করা আর নতুন বনায়ন কার্যক্রম বেগবান করা। দেখা গেছে যে, নির্বিবাদে বৃক্ষ কর্তনের ফলে মাটি উদোম হয়ে ক্ষয়ে যায়। মাটি দৃঢ়তা হারায়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীদের আবাসস্থল বিলুপ্ত হয়।

কপ ৩০ এর সিদ্ধান্তের মধ্যে ভালো দিকগুলো হলো: 
‘বেলেম রাজনৈতিক প্যাকেজ’ নামে ২৯টি সিদ্ধান্তযুক্ত একটি প্যাকেজ পাস করা সম্ভব হয়েছে। প্যাকেজে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ১. উষ্ণমণ্ডলীয় বন ও আদিবাসী অধিকারভিত্তিক বৈশ্বিক জলবায়ু সংহতি; ২. প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিতকরণ; ৩. অভিযোজন অর্থায়ন বৃদ্ধির অঙ্গীকার; ৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামো শক্তিশালীকরণ; ৫. জলবায়ুনীতিতে লিঙ্গসমতা পদক্ষেপ এবং ৬. জলবায়ুবান্ধব ন্যায্য বাণিজ্য ও সবুজ অর্থনীতির দিকে রূপান্তরের নীতি উল্লেখযোগ্য।

ভূমিকম্প ও জলবায়ু পরিবর্তন এক কথা নয়। তবে ভূমিকম্পের ক্ষতি থেকে বাঁচতে দেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে, যার অন্যতম পূর্ব শর্ত জলবায়ু সমস্যায় মানিয়ে নেয়া বা অভিযোজন কাঠামোর ধাপে ধাপে উন্নয়ন। আর অভিযোজনের অর্থ প্রাপ্তি তরান্বিত করা। এখন আসা যাক ভূমিকম্পে আমাদের মতো দেশের কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন। 

স্বল্পমেয়াদি/তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি:
১. ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত ও স্থির থাকতে হবে। ভবনের নিচতলায় থাকলে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে।
২. বহুতল ভবনে থাকলে ড্রপ কভার হোল্ড পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে : নিচু হতে হবে, শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে খুঁটি শক্ত করে ধরতে হবে। অথবা, কলামের পাশে, বিমের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। সম্ভব হলে বালিশ, কুশন বা এ জাতীয় বস্তু দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে।
৩. ভূমিকম্প চলাকালীন লিফট ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ভূমিকম্প থামার সাথে সাথে বৈদ্যুতিক ও গ্যাস সংযোগ দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
৪. বারান্দা, ব্যালকনি, জানালা, বুকশেলফ, আলমিরা, কাঠের আসবাবপত্র বা কোনো ঝুলন্ত ভারী বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে। হাতের কাছে টর্চ, হেলমেট, জরুরি ওষুধ এবং বাঁশি সংরক্ষণ করতে হবে যাতে প্রয়োজন হলে ব্যবহার করা যায়।
৫. ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি থেকে দূরে খোলা স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
৬. গাড়িতে থাকলে ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামাতে হবে। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই থাকতে হবে।
৭. একটি ভূমিকম্পের পর আবারও ভূকম্পন হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, ব্রিজ ও বিভিন্ন অবকাঠামো থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ পরবর্তী ভূমিকম্পে সেগুলো পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
৮. সকলের সম্মিলিত চেষ্টা ও সচেতনতায় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখা সম্ভব। 

জরুরি সেবার প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স হটলাইন নম্বর: ১০২-এ।

দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি:

১. বিশেষভাবে ঢাকা শহরের ফুটপাথ, জলাধার, নদীর চারপাশ অবৈধ স্থাপনা, দোকানপাট, ছোটো শিল্প ও স্থাপনা অপসারণ করতে হবে

২. নতুন পার্ক, খোলা জায়াগা সৃষ্টি করতে হবে ও পুরোনো ভবন ভেঙে ফেলতে হবে

৩. নতুন ভবন বা স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও সহনশীল মাত্রায় তৈরি করতে হবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও এর ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যাপারে প্রতিরোধ কার্যক্রম সফলতা বয়ে আনতে পারে। দুর্যোগ প্রতিরোধে কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত প্রশমনের ব্যবস্থা রয়েছে।

নিচে অবকাঠামোগত প্রস্তুতিগুলো কী হতে পারে আসুন জেনে নেওয়া যাক-

উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানখ ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টিঅবকাঠামোগত প্রশমন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সুতরাং বলা যায়, কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা শহর ও অন্যান্য বড় বড় শহরকে ভূমিকম্প সহনশীল আধুনিক নগরে রূপারন্তরিত করতে হবে। টাস্কফোর্স ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ও ভূমিকম্প মক অনুশীলনের মাধ্যমে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে সেই উদ্দেশ্যে সরকারকে সবরকম সহযোগিতা দেওয়ার এজেন্ডা নিতে হবে।

সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ভূমিকম্পকালিন প্রস্তুতিতে আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ফান্ডের দ্বারস্থ হবার জন্য নীতিনির্ধারকদেরকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

আরও পড়ুন
পাঁচ শতাব্দীর ভূকম্পনের ইতিহাস
অনেকেই ভূমিকম্প টের পান না, কিন্তু কেন?

কেএসকে/এমএস

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow