ভোটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন প্রবাসীরা

3 hours ago 4

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ বাংলাদেশি, যারা প্রবাসে থাকে, রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। ভোটাধিকারের মতো মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে সবসময় তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা ভোটাধিকার পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছেন।

অন্যদিকে ভোটাধিকার পেলে প্রবাসীরা পারস্পরিক দ্বন্দ-সংঘাতে লিপ্ত হবে কিনা, তাতে প্রবাসী শ্রম বাজারে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- এ বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন দূতাবাস কর্মকর্তা ও কমিউনিটি নেতারা।

স্বাধীনতার পর থেকে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরা যেন ভোট দিতে পারেন, এটা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু অতীতের কোনো সরকারই এই দাবি পূরণে সত্যিকার আন্তরিকতা দেখায়নি। অথচ এই দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিক এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রবাসীরা মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকার কখনো আগ্রহ দেখাবে না। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে দেশের হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল নব্বই দশকে। শুনানির পর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। পরে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি, দেশের প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসরে যান। ইতোমধ্যে তিনি মারা ও গেছেন, অথচ তার রায়কে আজও বাস্তবায়ন করে প্রবাসীদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়নি। 

এ বিষয়ে আবুধাবি কমিউনিটি নেতা সিফাত উল্লাহ বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বীকৃত ‘লাইফ লাইন’। বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে শত শত প্রবাসী জেল খেটেছে, অবশেষে ব্যবসা- বাণিজ্য, চাকরি ছেড়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। অথচ সেই প্রবাসীদের মত প্রকাশের অধিকার ভোট থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে সব সময়। সর্বশেষে গত বছর ৫ আগস্টের আগে মাসব্যাপী রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে পতিত সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল প্রবাসীরা। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কয়েক মাস আগে জানিয়েছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার ফলে বৈদেশিক রিজার্ভে হাত না দিয়েই বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। সুতরাং এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা দেড় কোটি প্রবাসীকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আবুধাবি বিএনপির সাবেক সভাপতি কিবরিয়া আমান প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, আরব আমিরাতে প্রায় ২৩ লাখ ভারতীয় রয়েছে, তাদের ও দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলে সমর্থন রয়েছে তবে বিবাদে জড়ানোর নজির নেই। কিন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বিপরীত চিত্র। তাই প্রবাসীরা ভোট দিতে গিয়ে যাতে সংঘাতে না জড়ায় সে নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রবাসীদের অকুণ্ঠ সমর্থন আছে। যে কোনোভাবে এ সরকারকে সফল হতেই হবে। সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এবং দেশ গড়তে উপযুক্ত প্রতিনিধিদের ম্যান্ডেট দেওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ থেকে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ বাংলাদেশি যারা প্রবাসে থাকেন তাদের বঞ্চিত করলে এবং তাদের মৌলিক অধিকার দিতে অবহেলা করলে বরং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং এত বিপুলসংখ্যক প্রবাসীদের ভোটাধিকারের মতো মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার দিতে অবহেলা করে রাষ্ট্রের টেকসই সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব নয়। দেড় কোটি প্রবাসীকে সন্তুষ্ট করে, তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করলে, তার বিনিময়ে প্রবাসীরা আরও কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে অভিমত প্রবাসীদের। 

ভোটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার প্রবাসী নেতারা মনে করেন, পতিত সরকার ও প্রতিবেশী বড় একটি দেশ বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন‍্য দেশের ভেতর ও বাইরে বহুমুখী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে অনবরত মিথ্যা ও আজগুবি প্রচারণা এবং প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। প্রতিবেশী বড় দেশের লবিং পাওয়ার, যোগাযোগ ও ডায়াসপরা অনেক বড় ও ব্যাপক। এগুলোর মোকাবিলা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের একটি পজিটিভ দিক হচ্ছে- তার দেড় কোটি নাগরিক প্রবাসী। তাদের মৌলিক ভোটাধিকার দিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত করলে তারা দেশের বাইরে বাংলাদেশের জন্য এবং বাংলাদেশের ইমেজ বাড়াতে এক একজন আনঅফিসিয়াল অ্যাম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করতে পারেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আরব আমিরাত সফরকালে কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিউনিটি নেতারা প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে, তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে না, পরবর্তীতে এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। 

সম্প্রতি  প্রবাস থেকে বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেছিলেন ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন পুরো নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে। নির্বাচন সংস্কার কমিশন নীতিগতভাবে একমত যে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দরকার। যতটুকু জানা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে গোটা নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা রাখেন। 

প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তরুণ সংগঠক ও রাজনৈতিক নেতা শাখাওয়াত হোসেন বকুল, তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেন, পৃথিবীর বহুদেশ তাদের প্রবাসী ভোটারদের গুরুত্ব সহকারে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করছে। ফরাসিরা তাদের প্রবাসীদের ব্যাপারে অনেক এগিয়ে। তারা শুধু প্রবাসীদের ভোটাধিকারই দেয়নি বরং ফ্রান্সের পার্লামেন্টে প্রবাসীদের সংরক্ষিত আসন রয়েছে। 

পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফরাসি নাগরিকদের জন্য মোট ১১টি নির্বাচনী এলাকা (Constituency) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে ফ্রান্সের জন্য ফরাসি প্রবাসী নাগরিকদের যে অবদান বাংলাদেশের জন্য প্রবাসীদের ভূমিকা কি কম? মোটেই না। বরং বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের প্রবাসীদের ভূমিকা অনেক বেশি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘ব্লাড সার্কুলেশন’ বলে অভিহিত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। ভোটাধিকার প্রবাসীদের ন্যূনতম মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এটা দিতে এতো গড়িমসি হবে কেন? আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে সব প্রবাসীদের সমবেত আওয়াজ তোলার আহ্বান জানান এই প্রবাসী নেতা।

তিনি মনে করেন, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়, তারাই পারবে প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে। তারা ক্ষমতায় এসেছেন একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যার সক্রিয় অংশীদার ছিল দেড় কোটি প্রবাসী। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই প্রবাসীরা প্রক্সি ভোট দিতে পারবেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

মঙ্গলবার (১১ মার্চ) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। মো. সানাউল্লাহ বলেন, প্রবাসীদের ভোটদানের জন্যে পোস্টাল ব্যালট কার্যকরী নয়। এ কারণে প্রক্সি ভোট পদ্ধতির সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যেই জানানো যাবে যে, কতদিনের মধ্যে উন্নত হবে এ প্রক্রিয়া। 

এর আগে, সোমবার (১০ মার্চ) নির্বাচন কমিশন জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রক্সি ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। নির্বাচন কমিশন জানায়, একটা অ্যাপস তৈরি করা হবে। সেখানে প্রবাসীরা নিবন্ধন করবেন। সেই অ্যাপসের মধ্যেই প্রবাসীরা তার নমিনি ঠিক করে দেবে এবং সেই নমিনি ভোট দিতে পারবেন। এভাবেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রক্সি ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বিগত শেখ হাসিনা শাসনামলে প্রবাসীদের দাবির মুখে কয়েকটি দূতাবাসে প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত শুরু হয়। এনআইডি প্রদান করতে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, মালদ্বীপ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে কার্যক্রম চালু রয়েছে। 

দুবাই কনস্যুলেট সূত্র জানায়, ১ জুলাই ২০২৩ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার প্রবাসীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেওয়া হয়েছে, একই সময়ে আবুধাবি দূতাবাস ২ হাজার ১৩০ জনকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করেছে। 

প্রবাসী ভোটাধিকার বিষয়ে আলাপকালে দুবাই কনস্যুলেটের প্রেস উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান (প্রথম সচিব, প্রেস উইং) নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়েও প্রবাসীদের একমত হবার নজির কম। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভিন্নতা রয়েছে। তারা প্রবাসীদের সাংগঠনিক অধিকার স্বীকার করে না। ফলে ভোটাধিকার পেলে প্রবাসীদের মাঝে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়তে পারে এবং সেটা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রূপ নিলে শ্রম বাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এই বিষয়ে সরকার উপযোগী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা এই কর্মকর্তার।

Read Entire Article