গত তিন বছর ধরেই মানুষ তার আয় দিয়ে ব্যয় সামলাতে পারছে না। এর মধ্যে সম্প্রতি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বেড়ে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বছরের পর বছর ধরে প্রগ্রেসিভ করের কথা বলা হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তানুযায়ী ১২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে গিয়েই কি তবে রিগ্রেসিভ করের পথেই হাঁটলো সরকার?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে ৪ দশমিক ৮০ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬৩ শতাংশই আদায় হবে পরোক্ষ কর যেমন ভ্যাট ও বিভিন্ন ধরনের আমদানি শুল্ক থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাওয়া অনুযায়ী বাড়তি ১২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায়ের পুরো চাপটাই দেওয়া হয়েছে পরোক্ষ করের ওপর, যা প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থার মূলনীতির পরিপন্থি। কারণ, পরোক্ষ করের মাধ্যমে এই বাড়তি টাকা আদায়ের ফলে পরোক্ষ করের অংশ আরও বাড়বে। অন্যদিকে, আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা। সবধরনের নিত্যপণ্য এবং সেবাখাতের খরচ বাড়বে। জনজীবনে নেমে আসবে দুর্ভোগ।
আমাদের দেশে দাম বাড়ার আওয়াজ পেলেই সেই পণ্যের মজুদ শুরু হয়ে যায়। গত দুই তিন দিনে যারা বাজারে গেছেন তাদের নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা হয়েছে। চালের সাথে বেড়েছে তেলের দাম। সিগারেটের স্টলে সিগারেট মিলছেনা। ওষুধের ফার্মেসিতে ওষুধ মিলছে না। বিক্রেতারা বলছেন সরবরাহ নেই। সব মিলিয়ে সেই পুরাতন নাটক চলছে। আর ক্রেতার নাভিশ্বাস-দুর্ভোগ বাড়ছে।
মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে কি আদৌও উন্নয়ন সম্ভব। দেশের উন্নয়ন মানে দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। সরকারের সকল কাজের লক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে দেশের উন্নতি হবে, মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়শই এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। বর্তমানে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বাড়া, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় করের বোঝা বাড়ানো শুধু সাধারণ জনগণের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে, তা নয়, এটি ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগেও বাধা সৃষ্টি করবে। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে এবং জনগণের জন্য জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। সেই দুর্ভোগ আরো বাড়বে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, গত তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর মধ্যে কর বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে। চাপ কতটা বেড়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় আমদানিতে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। এর ওপর ছিল ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট। আর এখন ডলারের মূল্য ১২০ টাকা। এর ওপর দিতে হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। তাহলে বুঝুন চাপ কেমন বেড়েছে, কতটা বেড়েছে। তার মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে থাকা মানুষের ওপর এই সময়ে নতুন করে কর বাড়ানো ঠিক হয়নি। স্বল্প-আয়ের মানুষের খরচ আরও বাড়বে। পাশাপাশি ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ আরও বাড়াবে।
আমরা সাধারণ মানুষ এটাই বুঝছি যে, এই চাপের বড় অংশই যাবে নিম্ন-আয় ও সাধারণ ভোক্তাদের ঘাড়ে। অর্থবছরের মাঝে এসে এভাবে ঢালাওভাবে কর বাড়ানো মোটেই উচিত হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। এখন দেখার বিষয়, আসলেই তেমনটি হয় কিনা।
আসলে ক্ষমতায় গেলে যে কেউই দেশের মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে যায়। সরকার বলছে ভ্যাট বাড়ালেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না, কিন্তু এটি ঠিক নয়। সরকার পোশাক, বিমান এমনকি এলপিজি গ্যাস, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারসহ শতাধিক পণ্যসামগ্রীর ওপর ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সাবান, ওষুধ, মিষ্টি, বিস্কুট, টমেটোর সস, ফলের জুস, সিগারেট, আচার, বার্নিশ ও লেকার, ডিটারজেন্ট পাউডার, মোবাইল সেবা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটসহ শতাধিক পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে দেশের মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এ ধরনের ভ্যাট বৃদ্ধি করা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে শুধু মূল্যস্ফীতি বাড়বে তা নয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হতে পারে। কষ্ট-দুর্ভোগে চলা গরিব মানুষের ওপর করের চাপ বৃদ্ধি দুঃখজনক।
বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হচ্ছে কর। যিনি যত বেশি ধনী তিনি তত বেশি আয়কর দেবেন। আর আমাদের দেশে করের আওতা না বাড়িয়ে রাজস্ব আয়কে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এখানে বৈষম্য রয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করে, ভ্যাট নয়, প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের ওপর থেকে করের বোঝা কমাতে হবে।
আমরা জানি, আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে এনবিআরের জটিলতার কোনো সীমা নেই। বিত্তশালী বা বড় ব্যবসায়ীরা নানা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন। বর্তমান সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের জন্য রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং তা আদায় করতে হবে। আশা করি মানবিক দৃষ্টিতে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রথা থেকে সরকার জনস্বার্থে সরে আসবে অথবা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস