একটা মুরগি মানুষের সামনে এলেই আঁতকে উঠে, পালানোর চেষ্টা করে বা স্থির হয়ে যায় দেখে আমরা হয়তো হাসি। কিন্তু এই ‘ভয়’ আসলে মুরগির মনের গভীর ব্যথার প্রকাশ। প্রতিদিন খামারে মানুষের উপস্থিতি মুরগির জীবনের অংশ হলেও, অনেক সময় সেই উপস্থিতিই হয়ে ওঠে মানসিক চাপের উৎস। আর এই ভয়ই ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয় তাদের উৎপাদন, প্রভাব ফেলে স্বাস্থ্যে ও কল্যাণে।
ভয় কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি এক প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষামূলক প্রক্রিয়া। প্রাণী যখন মনে করে তার আশপাশে বিপদ আছে, বাস্তব বা কল্পিত তখনই শরীরে ‘ভয় প্রতিক্রিয়া’ শুরু হয়। এটি ঠিক যেমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা আমাদের শরীরকে কাজ করায়, তেমনই ভয়ও মুরগিকে সতর্ক ও সুরক্ষিত থাকার প্রেরণা দেয়। তবে সমস্যাটা শুরু হয় যখন এই ভয় দীর্ঘস্থায়ী হয়।

প্রথমে মুরগির শরীরে অ্যাড্রেনালিন নিঃসৃত হয়, যা হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, পেশিতে শক্তি জোগায়। যদি ভয় কাটে না, তখন শরীরে কর্টিকোস্টেরন নামে এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন বাড়তে থাকে। স্বল্পমেয়াদি ভয় (যাকে বলে অ্যাকিউট স্ট্রেস) তেমন ক্ষতিকর নয়; কিন্তু ভয় যদি বারবার আসে, তখন তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ (ক্রনিক স্ট্রেস), যা মুরগির শরীর ও মন উভয়ের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ মুরগির ডিম দেওয়ার সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ভয় ও স্ট্রেসে থাকা পাখিরা কম খায়, কম বেড়ে ওঠে এবং কম ডিম পাড়ে। তাদের শরীরে প্রোটিন ভাঙন বেড়ে যায়, ফলে শক্তি অপচয় হয় ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খামারে যদি মানুষ হঠাৎ চিৎকার করে, আক্রমণাত্মকভাবে ধরে বা হুমকিমূলক ভঙ্গিতে চলে তাহলে তা মুরগির জন্য বড় মানসিক আঘাত। এই ধরনের আচরণ শুধু ভয়ই নয়, উৎপাদন কমানো ও ডিমের খোল বিকৃত হওয়ার অন্যতম কারণ।

অনেক সময় ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে পাখিরা খাঁচায় নিজে বা পাশের মুরগিকে আঘাত করে, ফলে চোট ও সংক্রমণ দেখা দেয়। সব মিলিয়ে ভয় কেবল মুরগির কল্যাণ নয়, খামারের অর্থনৈতিক দিকেও সরাসরি প্রভাব ফেলে।
ভয় কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ইতিবাচক মানবিক আচরণ। গবেষণায় প্রমাণিত, নিয়মিত ও শান্ত স্বরে মানুষের সংস্পর্শে আসা পোলট্রিগুলো দ্রুত মানুষের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের হৃদস্পন্দন কম থাকে, খাদ্যগ্রহণ স্বাভাবিক হয় এবং উৎপাদন বেড়ে যায়। এখানে শারীরিক স্পর্শের প্রয়োজন নেই; ধীর গতিতে হাঁটা, শান্ত কণ্ঠে কথা বলা, নিয়মিত দৃষ্টিসংযোগ রাখা-এসবই পাখির মনে নিরাপত্তা তৈরি করে।
তাছাড়া, পরিবেশগত সমৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ, খাঁচার ভেতর খেলনা, দণ্ড বা বিভিন্ন আকৃতির বস্তু রাখলে মুরগি নতুন জিনিসের সঙ্গে অভ্যস্ত হয় এবং অপরিচিত বস্তুকে ভয় না পায়।

দীর্ঘমেয়াদে জেনেটিক নির্বাচন, অর্থাৎ কম ভয়প্রবণ জাত তৈরি করাও কার্যকর সমাধান হতে পারে। শান্ত স্বভাবের মুরগি পালনে সহজ ও উৎপাদনেও এগিয়ে থাকে।
একটা মুরগি ভয় পেলে কেবল ডিম কম দেয় না, তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে খামারে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ে। অন্যদিকে, ভয়মুক্ত পাখিরা থাকে সক্রিয়, সুস্থ ও উৎপাদনশীল। তাই সফল খামারের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত, ‘ভালো ব্যবহার, ভালো ফলন’।
প্রতিটি প্রাণী, এমনকি মুরগিও অনুভূতির অধিকারী। একটু ধৈর্য, একটু যত্ন ও কিছুটা ভালোবাসা দিয়েই খামারে তৈরি করা যায় ভয়হীন, সুস্থ ও লাভজনক পরিবেশ।

ভয়কে উপেক্ষা করা মানে উৎপাদন কমে যাওয়া, প্রাণিকল্যাণ নষ্ট হওয়া। খামারে কর্মীদের উচিত মুরগির ভয়ের ভাষা বোঝা-তাদের আচরণ, চোখের নড়াচড়া বা হঠাৎ থেমে যাওয়া আসলে এক নিঃশব্দ আর্তনাদ। মুরগির ভয় বুঝতে পারলেই খামার হবে প্রাণবন্ত, উৎপাদন হবে টেকসই আর প্রাণিকল্যাণও নিশ্চিত হবে।
তথ্যসূত্র: পোলট্রি হাব–অস্ট্রেলিয়া
জেএস/

2 hours ago
3








English (US) ·