মননশীলতা বনাম বাণিজ্যিক বিনোদন

2 hours ago 6

একসময় উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি (Highbrow culture) বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এই সংস্কৃতি অভিজাত রুচি, পরিশীলিত সংবেদনশীলতা এবং গভীর মননের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এটি কেবল ধনী বা অভিজাত শ্রেণির বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য, ধ্রুপদী সংগীত, নাটক ও চারুকলার মধ্য দিয়ে জাতীয় আন্দোলন, প্রগতিশীল চিন্তা এবং মানবিক মূল্যবোধকে রূপ দিয়ে একটি জাতিসত্তার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

তবে গত কয়েক দশক ধরে এই সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজ, বাজার অর্থনীতির বাণিজ্যিকীকরণ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দ্রুত প্রসারের কারণে জনপ্রিয় সংস্কৃতি উচ্চবিত্ত ঐতিহ্যকে গ্রাস করছে। একসময়কার প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক ধারা যেমন রবীন্দ্রসংগীতের অন্তর্মুখী সুর, নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা, জীবনানন্দের বিষণ্ন আধুনিকতা, অথবা ঢাকার মঞ্চ নাটক—এগুলো এখন ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।

এই সাংস্কৃতিক অবক্ষয় কেবল একটি সাধারণ পরিবর্তন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর, বিশ্বায়নের প্রভাব এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এর প্রভাব শুধু নান্দনিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জাতীয় পরিচয়, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণশক্তি এবং সামাজিক সংহতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধানে আমাদের ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশ্লেষণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে, পিয়েরে বোর্দিউর 'সাংস্কৃতিক মূলধন' (Cultural Capital) এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভিত্তি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিক সাধনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এর সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের (বেঙ্গল রেনেসাঁস) মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং পরবর্তীকালে কাজী নজরুল ইসলামের মতো মহান ব্যক্তিত্বরা সাহিত্য ও সংগীতকে সামাজিক পরিবর্তনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছিলেন। এই সাংস্কৃতিক রূপগুলো সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না, বরং তা স্বাধীনতা, সামাজিক সংস্কার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কণ্ঠস্বর দিয়েছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সেসময় কবিতা, দেশাত্মবোধক গান এবং নাটক রাজনৈতিক প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক গর্বের ওপর ভিত্তি করে একটি সম্মিলিত পরিচয় গড়ে তুলেছিল। একইভাবে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গান, কবিতা এবং শিল্পকর্ম জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিল। স্বাধীনতার পর, ঢাকার থিয়েটার পাড়া, কবিতা সমাবেশ এবং সংগীত সন্ধ্যাগুলো এই বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারকে সযত্নে বহন করে চলেছে।

অতএব, বাংলাদেশের উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি কেবল অবসর বিনোদনের বিষয় ছিল না। এটি ছিল সামাজিক রূপান্তর, নাগরিক সংলাপ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক শক্তিশালী মাধ্যম। এর বর্তমান পতন শুধু একটি সাংস্কৃতিক ক্ষতিই নয়, বরং এটি সেই বুদ্ধিবৃত্তিক আঠার দুর্বলতাকেও চিহ্নিত করে, যা একসময় এই জাতিকে সংহত করে রেখেছিল।

উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতির পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সংস্কৃতির (Popular Culture) অপ্রতিরোধ্য উত্থান। ১৯৯০-এর দশকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমন এবং পরবর্তীকালে ২০০০-এর দশকে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে, বাংলাদেশের দর্শকরা বলিউড, হলিউড এবং বিশ্বব্যাপী স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে পরিচিত হয়। বর্তমানে, টিকটক, ইউটিউব এবং ফেসবুক আমাদের অবসর সময়কে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছে। এই প্লাটফর্মগুলো তাদের সংক্ষিপ্ত, বাণিজ্যিক ও দ্রুত বিনোদন-নির্ভর কন্টেন্ট দিয়ে আমাদের নান্দনিক সংবেদনশীলতাকে নতুনভাবে রূপ দিচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর ও অন্তর্মুখী গান কিংবা জীবনানন্দের স্তরযুক্ত কবিতার বিপরীতে, জনপ্রিয় সংস্কৃতি নির্ভর করে তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি এবং ব্যাপক গণ-আবেদনের ওপর। এটি বিশ্বব্যাপী একটি প্রবণতা হলেও, বাংলাদেশে এর প্রভাব আরও তীব্র হয়েছে। কারণ, আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো—যেমন লাইব্রেরি, থিয়েটার এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র—বিশ্বব্যাপী বিনোদন জায়ান্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব ছিল।

উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি কেবল রুচির পরিচায়ক নয়, বরং একটি সমাজের গভীর চিন্তাভাবনা, সম্মিলিতভাবে স্বপ্ন দেখা এবং বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সংযোগ স্থাপনের সক্ষমতাকেও তুলে ধরে। তাই, এই সংস্কৃতির পতন শুধু একটি সাংস্কৃতিক ক্ষয় নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ।

এই সাংস্কৃতিক পতন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং দ্রুত নগরায়ণের এই সমাজে গভীর রুচি বা মননশীলতার চর্চার সুযোগ খুব কম। পরিবারগুলো শিক্ষাকে মূলত চাকরি পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখে। তাই, মানবিক বিদ্যা (Humanities) এবং শিল্পকলার চেয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) অথবা ব্যবসায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই ধরনের বাস্তববাদী মানসিকতা মৌলিক শিক্ষার বাইরে সাহিত্য, চারুকলা বা সংগীতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনকে নিরুৎসাহিত করে।

গ্রামাঞ্চলে, যাত্রাপালা বা লোকগানের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কার্যক্রমগুলো এখন সস্তা টেলিভিশন সিরিয়াল এবং ডিজিটাল বিনোদন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। শহুরে জীবনে, শিক্ষার্থী ও পেশাদাররা সবাই পরীক্ষার প্রস্তুতি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ক্যারিয়ার-ভিত্তিক কার্যক্রমে ব্যস্ত। এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজে উচ্চবিত্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এক অসাধ্য বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।

সাংস্কৃতিক মান গঠনে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতীতে, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কারিগরি জ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন এবং শিল্পকলার প্রতি মূল্যায়নবোধ তৈরি করত। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ-নির্ভর হওয়ায় সেখানে সৃজনশীল বা বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষণের কোনো সুযোগ নেই। সাহিত্যের ক্লাসগুলো প্রায়শই পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা এর নান্দনিক আনন্দকে নষ্ট করে দেয়। একসময় যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সীমিত সম্পদের কারণে সেগুলো তাদের সেই ভূমিকা হারাচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আধুনিক সুবিধা দিলেও, তাদের অধিকাংশই ক্যারিয়ার-ভিত্তিক শাখাগুলোতে বেশি মনোযোগ দেয়, যেখানে শিল্প ও মানবিক বিভাগগুলো প্রায়ই অবহেলিত থাকে। এর ফলে, একটি প্রজন্ম উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি র সঙ্গে গভীর সংযোগ ছাড়াই বেড়ে উঠছে, যা তাদের মননকে সংকীর্ণ করে তুলছে।

নগর জীবন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্থানগুলোকে নতুন করে সাজিয়েছে। একসময় ঢাকায় প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সেলুন, বইয়ের দোকান এবং থিয়েটার মঞ্চ ছিল। আজ, বাণিজ্যিক মল, কফি চেইন এবং ফাস্ট-ফুড রেস্তোরাঁগুলো সেই স্থান দখল করে নিয়েছে। থিয়েটার হলগুলোতে দর্শকসংখ্যা ক্রমশ কমছে। অন্যদিকে, কনসার্টগুলো এখন পপ সংগীত এবং বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার ওপর বেশি নির্ভরশীল। যদিও একুশে বইমেলা এখনো প্রচুর মানুষকে আকর্ষণ করে, কিন্তু প্রকাশনার বাণিজ্যিকীকরণ প্রায়শই মানের চেয়ে পরিমাণকে অগ্রাধিকার দেয়, যার ফলে গুরুতর সাহিত্য জনপ্রিয় ধারার ভিড়ে হারিয়ে যায়।

বাংলাদেশে সংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরে রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, প্রায়শই প্রগতিশীল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার শিকার হয়েছে। এর ফলে, তহবিল ও স্বীকৃতি এখন যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়। এটি সৃজনশীল স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রান্তিক হয়ে পড়েছে এবং সমাজকে একত্রিত করার তার পূর্বের ভূমিকা হারিয়েছে।

উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি মননশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা তৈরি করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ার জন্য যেমন গভীর মননের প্রয়োজন, তেমনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুর শোনার জন্য দরকার ধৈর্য ও মনোযোগ। সেলিম আল-দীনের নাটক দেখা সমাজ এবং ইতিহাস সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে। এ ধরনের অনুশীলনের অভাবে একটি সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অগভীর হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। দ্রুত ও উপভোগ্য বিনোদনের এই যুগে সমালোচনামূলক চিন্তা এবং গভীর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ক্রমশ লোপ পাচ্ছে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তার সাহিত্য, সংগীত এবং শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সত্যজিৎ রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা বিশ্বমঞ্চে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিলেন। আজ যখন তরুণ প্রজন্ম বলিউড বা কে-পপের মতো সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে, তখন আদিবাসী ঐতিহ্যগুলো সম্মিলিত চেতনা থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি র এই দুর্বলতা জাতীয় পরিচয়কেও দুর্বল করে তুলছে, যা এক ধরনের বৈশ্বিক সংস্কৃতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।

এই সাংস্কৃতিক অবক্ষয় সমাজে শ্রেণি বৈষম্যকে আরও গভীর করছে। উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি প্রায়শই অভিজাত বলে সমালোচিত হলেও, এটি শিল্পী, লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের জন্য সামাজিক গতিশীলতার পথ তৈরি করত। এখন এই সাংস্কৃতিক মূলধনের প্রবেশাধিকার কেবল সেইসব অভিজাতদের কাছেই সীমিত, যাদের বিদেশে পড়াশোনা করার অথবা দুর্লভ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।

একসময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রিত করত। কবিতা পাঠ, সংগীত সন্ধ্যা বা নাটক ছিল সংলাপ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কেন্দ্র। আজকের সাংস্কৃতিক ভোগ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও ডিজিটাল, যা বিচ্ছিন্ন প্রতিধ্বনি কক্ষ (Echo Chambers) তৈরি করে। সম্মিলিত সমাবেশের পরিবর্তে মানুষ এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংস্কৃতি গ্রহণ করে, যা তাদের বিদ্যমান রুচিকেই আরও শক্তিশালী করে।

বাংলাদেশে উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি র এই পতন সম্পূর্ণ বা অপরিবর্তনীয় নয়। জনপ্রিয় সংস্কৃতির আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও, এই ঐতিহ্যকে নতুন দর্শকদের কাছে নিয়ে আসার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজের অনলাইন আর্কাইভ, ধ্রুপদী সংগীতের ইউটিউব চ্যানেল, অথবা বাংলাদেশী সাহিত্য নিয়ে পডকাস্টের মাধ্যমে প্রযুক্তিসচেতন তরুণদের মধ্যে এই বিষয়ে আগ্রহ নতুন করে জাগানো সম্ভব।

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যক্রমে শিল্প ও মানবিক বিষয়গুলোকে আরও অর্থপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃজনশীল ক্লাবগুলোকে উৎসাহিত করা এবং গ্রন্থাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। একই সাথে, রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে মেধার ভিত্তিতে বিতরণ করা উচিত।

সর্বোপরি, উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি কে অভিজাতদের পরিবর্তে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হিসেবে নতুন করে ভাবতে হবে। যখন পাবলিক পার্কে কবিতা পাঠের আসর বসবে, যখন নাট্যদলগুলো গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করবে, যখন সংগীত উৎসবে ধ্রুপদী ও সমসাময়িক ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটবে, তখন উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি তার শ্রেণিগত বাধা অতিক্রম করতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে তার প্রাসঙ্গিকতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

বাংলাদেশে উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি র পতন বৃহত্তর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বিশ্বায়নের রূপান্তরকেই প্রতিফলিত করে। এর মূল কারণগুলো—বাণিজ্যিকীকরণ, শিক্ষাগত অবহেলা এবং আর্থ-সামাজিক চাপ—শুধু নান্দনিক নয়, বরং কাঠামোগত। এর পরিণতি মারাত্মক: সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার ক্ষয়, জাতীয় পরিচয়ের দুর্বলতা, বৈষম্যের গভীরতা এবং আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক মর্যাদার হ্রাস। তবুও এই গল্পটি কেবল অবক্ষয়ের গল্প নয়। উদ্ভাবনী অভিযোজন, নতুন বিনিয়োগ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার উচ্চবিত্ত ঐতিহ্যকে রক্ষা ও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, যা একবিংশ শতাব্দীতেও সমাজকে সমৃদ্ধ করে চলবে।

উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি কেবল রুচির পরিচায়ক নয়, বরং একটি সমাজের গভীর চিন্তাভাবনা, সম্মিলিতভাবে স্বপ্ন দেখা এবং বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সংযোগ স্থাপনের সক্ষমতাকেও তুলে ধরে। তাই, এই সংস্কৃতির পতন শুধু একটি সাংস্কৃতিক ক্ষয় নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article