ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকা মহাখালী ডিওএইচএস। এই এলাকার পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও শিশুদের নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) তামাক কারখানার কারণে। একটি আবাসিক এলাকার ভেতরে এমন একটি মারাত্মক ক্ষতিকর শিল্পপ্রতিষ্ঠান কীভাবে এতদিন ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
সকলেই জানি, তামাক এমন একটি পণ্য যা মানবদেহে ক্যান্সার, হৃদ্রোগ, ফুসফুসের জটিলতা, অ্যাজমা, স্ট্রোকসহ নানা মরণব্যাধির জন্ম দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে তামাকজনিত কারণে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং আরও ১৫ লাখের বেশি মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
এও জানি ঢাকা শহরের শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে । এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৯২% শিশুর মুখে নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ভয়াবহ বার্তা।
এরপরেও বিস্ময় বিএটির কারখানাটি এখনো ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে । রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালে এই কারখানা স্থাপন করা হলেও তখনকার মহাখালী ছিল এক গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই অঞ্চল এখন ঢাকার কেন্দ্রীয় ও অভিজাত আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। কারখানাটি এখনো এখানেই রয়ে গেছে। এখানে বসবাসের পরিস্থিতি বদলেছে। কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া ও রাসায়নিক উপাদান আশপাশের বাসিন্দাদের জীবনের উপর প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ সকলেই আক্রান্ত হচ্ছেন নানা ধরনের শ্বাসকষ্টজনিত ও ক্যান্সারজনিত রোগে।
বায়ুদূষণের পাশাপাশি পরিবহন-জনিত হুমকি বাড়ছে। কেননা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাঁচামাল আনায় বড় বড় ট্রাক-লরি এবং এসবের চলাচলে এলাকায় তীব্র যানজট, শব্দদূষণ ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রকট। যা একটি আবাসিক এলাকার জন্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন” প্রণয়ন করে, যা ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়। এই আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহন -এ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ।
এই আইন অনুসারে স্কুল, হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি অফিস, লিফট, রেস্টুরেন্ট, থিয়েটার, বাস টার্মিনালসহ যেসব স্থানে জনসমাগম ঘটে, সেসব এলাকাকে তামাকমুক্ত রাখতে হবে। অথচ বিএটির কারখানা মহাখালী ডিওএইচএসের মধ্যেই অবস্থিত, যেখানে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বহু আবাসিক ভবন রয়েছে। এটি ওই আইনের চরম লঙ্ঘন এবং জনস্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক আঘাত।
আরও দুঃখজনক যে, ২০২৩ সালে তামাক কোম্পানির চাপে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় পরিবর্তন এনে তামাক কারখানাকে “লাল শ্রেণি” থেকে নামিয়ে কমলা শ্রেণিভুক্ত করা হয়, এবং তামাক চাষে ২৫% শুল্ক তুলে নেওয়া হয়। এটি স্পষ্টভাবে তামাক শিল্পের লবির বিজয় এবং কিন্তু জনস্বার্থ উপেক্ষার জ্বলন্ত প্রমাণ।
যদি বিশ্বের দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তবে দেখা যায়, অনেক নামকরা শহরের ভেতর থেকে তামাক কারখানা অপসারিত জন দাবিতে। ব্যাংককে বিএটির ২০০ একরের জমিতে এখন গড়ে উঠেছে এখন বেঞ্জাকিটি ফরেস্ট পার্ক, একটি পাবলিক পার্ক। গ্রীসের এথেন্সের শতবর্ষী তামাক কারখানা এবং কুর্দিস্তানের সুলায়মানিয়ায় একটি তামাক কারখানা বর্তমানে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত । মেলবোর্নের তামাক কারখানার জায়গায় তৈরি হয়েছে শতকোটি ডলারের আধুনিক ব্যবসা কেন্দ্র। অথচ আমরা এখনো মহাখালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকায় তামাক কারখানা রেখে জনগণের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রেখেছি।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে বিএটি এই আবাসিক এলাকায় এখনো পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়ে চলছে? কীভাবে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করেও তারা নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে? এসব প্রশ্নের যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার এবং যদি কোনো অনিয়ম বা রাজনৈতিক প্রভাব থাকে, তা প্রকাশ্যে আনতে হবে।
তামাক শিল্পের অপসারণ শুধু আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা নয়, এটি জাতির স্বাস্থ্যগত ভবিষ্যৎ রক্ষা করার বিষয়। তামাক শিল্প বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০% বনভূমি ধ্বংস করছে, এবং সিগারেটের ফেলে দেওয়া অংশ থেকে। ১৫.৫২% অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
অতএব, এখন সময় এসেছে ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএস থেকে তামাক কারখানা সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। এটি শুধু একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের আহ্বান নয়, এটি একজন সচেতন নাগরিক, একজন অভিভাবক এবং একজন দায়িত্ববান দেশপ্রেমিক মানুষের দাবি।
ঐখানে বসবাসরত বন্ধু এবং সকলের একজন হিসেবে চাই, সরকার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে মহাখালীর ডিওএইচএস থেকে বিএটির তামাক কারখানা সরিয়ে নেবে, এবং সেখানে একটি স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব জনসেবা কেন্দ্র বা শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলবে। আমরা চাই একটি নির্ভার সবুজ প্রকৃতি, সতেজভাবে শ্বাস নিতে সবুজ ঢাকা।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/এমএস