মওলবি আশরাফ
মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ ও শান্তি সব সময় পাশাপাশি পথ চলেছে। একদিকে ছিল জুলুম ও শক্তির দম্ভ, অন্যদিকে ছিল ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। আরবের জাহেলি যুগেও দেখা যায় এই দ্বন্দ্বের চিত্র। মক্কার রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় হিলফুল ফুজুল—এক শান্তিসংঘ, যার লক্ষ্য ছিল মজলুমের পাশে দাঁড়ানো এবং জালেমকে প্রতিরোধ করা। সেই উদ্যোগে তরুণ মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও অংশ নেন যিনি পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলার নবি হিসেবে আরবসহ পুরো বিশ্বকেই জুলুম ও জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে বের করে ইমান ও ইনসাফের পথ প্রদর্শন করেন।
হিলফুল ফুজুল গঠনের প্রেক্ষাপট
মুহাম্মাদ (সা.) যখন ১৪-১৫ বছরের তরুণ, তখন মক্কায় সংঘটিত হয় এক ভয়াবহ যুদ্ধ, যাকে বলা হয় হরবুল ফিজার। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, একবার হাওয়াজিন গোত্রের উরওয়াতুর রাহহাল ইবনে উতবা আরবের একজন নেতা নুমান ইবনে মুনজিরের একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে আশ্রয় দেন। ব্যাপারটা বনু কিনানা গোত্রের বারাজ ইবনে কায়সের ভালো লাগেনি, তার কাছে মনে হয়েছিল কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়ার যোগ্যতা কেবল তার গোত্রই রাখে। এরপর এই ব্যাপারটা নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়, এক পর্যায়ে বারাজ উরওয়াকে হত্যা করে। ঘটনাক্রমে সেটা ছিল এমন মাস যখন যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। এ জন্যই তাকে ফিজার বা পবিত্রতা লঙ্ঘনের যুদ্ধ বলা হয়। (সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৫, ইফাবা)
কোরায়শ গোত্রের সাথে বনু কিনানার মৈত্রীচুক্তি ছিল, এর সূত্র ধরে তারাও যুদ্ধে অংশ নেয়। এই যুদ্ধ চার বছর স্থায়ী হয়। এই সময় তরুণ মুহাম্মাদের (সা.) চাচাগণ তাকেও যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যান। তিনি সরাসরি যুদ্ধ করেননি; কেবল চাচাদের ব্যবহৃত তীর সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন—তাও অল্প কয়েকদিনের জন্য। এরপর যদিও শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু যুদ্ধের ক্ষত ও ভয়াবহ স্মৃতি রয়ে যায়। এই যুদ্ধের পর মক্কার কিছু গণ্যমান্য মানুষের মনে হয়—এভাবে যুদ্ধবিগ্রহ চলতে পারে না, আমাদের প্রয়োজন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
হিলফুল ফুজুল গঠন
ফিজার যুদ্ধেরও বহু বছর আগে মক্কায় তিনজন শান্তিকামী মানুষ ছিলেন, যারা একটা শান্তিচুক্তি করে মক্কাকে নিরাপদ অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন। যুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব তার কবিতায় এ চুক্তির কথা বর্ণনা করেন এভাবে:
ان الفضول تحالفوا وتعاقدوا
الا يقيم ببطن مكة ظالم
امر عليه تعاهدوا وتواثقوا
فالجار والمعتر فيهم سالم
অর্থাৎ তিনজন ফজল ফজল ইবনে উদায়া, ফজল ইবনে ফুজালা এবং ফুজায়ল ইবনে হারিস সবার থেকে শপথ নিয়েছিলেন যে, মক্কায় কোনো জালেম থাকতে পারবে না। সবাই দৃঢ় শপথ করেছিল। ফলে মক্কার প্রতিবেশী ও অভ্যাগতরা সবাই নিরাপদ হয়ে গেল।
তিনজন ফজলের নাম অনুসারে সেই চুক্তির নাম ছিল ‘হিলফুল ফুজুল’। সর্বপ্রথম মুহাম্মাদের (সা.) আপন চাচা যুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব এই চুক্তির নবায়ন নিয়ে ভাবেন, এই লক্ষ্যে তিনি বনু হাশিম ও বনু তাইমকে নিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে একটি বৈঠক করেন। রাসুল (সা.) বলেন, সেই সময় আমি আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে উপস্থিত ছিলাম। আমাকে ওই শপথের পরিবর্তে যদি লাল উটও দেওয়া হতো, আমি তা গ্রহণ করতাম না। এখন ইসলামি যুগেও যদি আমাকে এমন শপথে ডাকা হয়, আমি অবশ্যই অংশ নেব। (সীরাতুল মুস্তফা, ইদরিস কান্ধলবী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৯, ইফাবা)
অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় সমাজ থেকে যেন জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করা হয় এবং দুর্বলদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়—তার জন্য সবাই চেষ্টা করবে। তারা আল্লাহর নামে শপথ করেন: যতক্ষণ না মজলুমের হক ফিরিয়ে দেওয়া হয়, ততক্ষণ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জালেমের মোকাবেলা করব। চুক্তির মূলধারা ছিল চারটি:
১. সমাজ থেকে অশান্তি দূর করা।
২. মুসাফিরদের হেফাজত করা।
৩. দরিদ্র-দুর্বলদের সাহায্য করা।
৪. জালেমকে প্রতিরোধ করা।
একটি হাদিসে এই চুক্তিকে ‘হিলফুল মুতাইয়াবিন’ বা পবিত্রাত্মাদের সংঘ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। (সীরাতুর রাসূল, মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫, হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ)
ওএফএফ