ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
মদিনায় হিজরত তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এতটাই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল যে, রাসুল (সা.) এবং তার সাহাবিগণ নিজ গৃহ, ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করে দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে বিশ্ববাসীর কাছে এক বিরল উদহরণ সৃষ্টি করেন। মক্কার কোরায়শদের নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা, স্বর্থপরতা, শত্রুতার প্রবণতা তাদেরকে এতটাই নীচে নামিয়েছিল যে, তারা আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে শুধু অস্বীকার করেনি, তাঁর গুরুত্ব অনুধাবনে যেমন ব্যর্থ হয়েছে তেমনি তাদের চিন্তা ও আচরণের কারণে কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্ববাসীর জন্যে এক নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে।
পূর্ববর্তী অনেক নবি-রাসুলের মতো নবিজিকেও (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করতে হবে এই ইশারা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আগেই দেওয়া হয়েছিল। নবিজিকে (সা.) তার হিজরতের শহর দেখানো হয়েছিল স্বপ্নে। নবিজি (সা.) বলেন, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি মক্কা থেকে এমন স্থানে হিজরত করেছি, যেখানে অনেক খেজুর গাছ রয়েছে। আমি ভাবলাম, এটি ইয়ামামা বা হাজার। পরে জানতে পারলাম যে, সেটি ইয়াসরিব তথা মদিনা। (সহিহ বুখারি: ৩৬২২) উল্লেখ্য, হিজরতের স্থান রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে নির্ধারণ করেননি বরং স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই মদিনাকে নির্বাচন করেছেন।
রাসুল (সা.) এবং তার সাহাবীদের মদিনায় হিজরত শুধু তাদেরকে শান্ত-নিরাপদ একটি পরিবেশ পেতেই সাহায্য করেনি, বরং দ্বীনকে বিশ্ব পরিমন্ডলে তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। হিজরতের মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ইসলামের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিল আরব-অনারব বিশ্বে। মাত্র কয়েক দশকেই ইসলাম বিশ্ববাসীর কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়তায় বিজয়ী হয়েছিল তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে।
মক্কার প্রতিকূল পরিবেশে ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া রাসুলসহ (সা.) তার সাহাবিদের জন্যে মোটেও অসম্ভব ছিল না। অনেক সাহাবি শহীদ হয়েছেন, নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অঙ্গ-প্রতঙ্গ হারিয়েছেন কিন্তু তাওহিদের বাণীকে সমুন্নত রেখে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, জীবনের চেয়ে দ্বীন বড়। আল্লাহ ও তার রাসুলের ভালোবাসায় যে কোন বিশ্বাসীই এমন নজির রাখতে সক্ষম। তবে কেন হিজরতের প্রয়োজন হলো?
হিজরত দুনিয়াবি কোনো অর্জন কিংবা সাময়িক কোনো প্রাপ্তির বাহ্যিক কৌশল ছিল না। বরং হিকমতের নিগূঢ় রহস্যে আবৃত মহান আল্লাহর নির্দেশনায় এ ছিল বিজয়ের দ্বার দিয়ে প্রবেশের নামান্তর। তাইতো, হিজরতের কয়েক বছরের ব্যবধানে যখন মুসলমানরা সংখ্যায়, ক্ষমতায়, ঐশ্বর্যে চিরচেনা মক্কার মুশরিক-কাফিরদের চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে, তখনও মহানবি (সা.) তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এমন কি মক্কা বিজয়ের সময়ও তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমার দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন যে কারণে মানুষ দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছিল।
রাসুলের (সা.) হিজরত পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কার্যক্রমকে পর্যালোচনা করলে যে কোনো সচেতন ব্যক্তি বেশ কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. হিজরত দ্বীনের স্বার্থেই হবে, ব্যক্তি স্বার্থে নয়।
২.আল্লাহ ও রাসুলের (সা.) নির্দেশনা ও পদ্ধতিতেই হিজরত করতে হবে।
৩. হিজতের উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নয় বরং দ্বীনকে বিজয়ী করা।
৪.দ্বীন প্রচার-প্রসারে হিজরত একটি উত্তম কৌশল।
৫. হিজরতের উদ্দেশ্য শুধু ছেড়ে যাওয়া নয় বরং বিজয়ী বেশে সেখানে আবার প্রবেশ করা।
৬. প্রতিশোধের চেয়ে ক্ষমা করার যোগ্যতা অর্জন করা বেশী সম্মানের, বেশি লাভজনক।
৭. হিজরত পালিয়ে যাওয়া নয় বরং ইমান রক্ষায় সবকিছু ত্যাগ করার মহিমা অর্জনের মাধ্যম।
৮. দ্বীন সকল কিছুর ঊর্ধ্বে তা প্রমাণে মুমিন জীবনে হিজরত এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
৯. ইমান রক্ষায় এবং দ্বীনের কারণ ব্যতীত হিজরত গ্রহণযোগ্য নয়।
১০. হিজরত মুমিনের জীবনে এমন স্বাধীনতা আনে যাতে সে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি পায় না বরং প্রতিশোধ ও ক্ষমা উভয় শক্তিই অর্জন করে নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহর ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করে।
উল্লেখ্য, হিজরত ফরজ কিনা এ বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে হিজরত করা উপরোক্ত পদ্ধতি, নীতি ও উদ্দেশ্যে বৈধ শুধু নয় বরং কল্যাণের। দারুল হরবে যদি ইমান হারানো অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, দ্বীন পালন যদি নিশ্চিতভাবে কঠিন হয়ে যায়, মুমিন জীবন যদি হুমকির মধ্যে পড়ে, তাহলে উপযুক্ত স্থানে হিজরত না করলেই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, শাস্তি দেয়া হবে বিচার দিবসে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি জুলুমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল। তবে যে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না, আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। (সুরা নিসা, ৯৭-৯৯) এ আয়াতগুলো মক্কার সেইসব মানুষদের জন্যে নাজিল হয় যারা মদিনায় হিজরত করে নি।
একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কখন একজন মুমিন হিজরত করবেন তা নির্ধারণ করা। এটি মোটেও এমন নয় যে, কোন মুসলমান সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ওপর কাফির-মুশরিকরা আক্রমণ করলে তাদেরকে মোকাবেলা না করেই মুসলমানরা হিজরত করে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেবে। বরং হিজরত করতে হবে অনন্যোপায় হয়ে যা আগেই বলা হয়েছে। দেখুন, রাসুল (সা.) এবং তার সাহাবিরা কী করেছেন?
হিজরতের মাত্র এক বছর পরই মক্কার কোরায়শরা মদিনায় অবস্থানরত মুসলমানদের শেষ করার জন্যে আক্রমণ করে। মদিনার মুসলমানগণ কিন্তু মদিনা ছেড়ে অন্য একটা নিরাপদ স্থান খুঁজতে যাননি। বরং তখন তারা মক্কার কুরায়শদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ফলে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যদিও মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কাফের-মুশরিকদের এক তৃতীয়াংশ তবুও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তারা যুদ্ধ করেন এবং বিজয়ী হন। সুতরাং হিজরতের আগে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়া ইমানের প্রথম দাবি। এ দাবি পূরণে মুমিনদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াও বাধ্যতামূলক।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে মুসলমানদের ইমানের দুর্বলতা ও অনৈক্য দেখে যে কোন মুমিনের হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মুসলমানরা ইসলামের শিক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে বলেই অমুসলিমরা সংখ্যায় কম হয়েও মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ছড়ি ঘোরাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। খুব নির্লজ্জভাবে মার খাচ্ছে বিশ্বে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি মুসলিমরা। এটা দুঃখজনক, সত্যিই দূঃখজনক।
শেষকথা হিসেবে সুরা নিসার একটি আয়াত উল্লেখ করতে চাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী। (সুরা নিসা: ৭৫)
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন!
লেখক: গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
ওএফএফ