দেশের অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোতে গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ খাবার নষ্ট হয় বলে ধারণা দেশের রেস্তোরাঁ মালিকদের। এর চেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় কমিউনিটি সেন্টার ও পার্টি সেন্টারগুলোতে। তবে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান কোনো সংস্থার কাছে নেই। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে জনপ্রতি খাদ্যের অপচয় বছরে ৮২ কেজি, যা চীন, যুক্তরাজ্য ও ভারতের চেয়ে বেশি।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ এখনো ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধার দেশের তালিকায় রয়েছে। ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতার দিক থেকে এ দেশ ১২৭টি দেশের মধ্যে ৮৫তম। তারপরেও খাদ্য নিয়ে এদেশে একধরনের ‘অন্যায্য বিলাসিতা’ রয়েছে। যে কারণে একদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ক্ষুধা-অনাহারে ভুগছে, অন্যদিকে কিছু জায়গায় থামছে না অপচয়।
গত বছর (২০২৪) জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা (ইউএনইপি) বিশ্বের খাদ্য অপচয় সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও উঠে আসে বিষয়টি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্রমেই খাদ্যের অপচয় বেড়েছে। প্রতি বছর এক কোটি ৪১ লাখ টন খাদ্যপণ্য অপচয় হয়। এটি ২০২১ সালে প্রকাশিত আগের প্রতিবেদনের এক কোটি ৬ লাখ টনের অপেক্ষায় এক তৃতীয়াংশ বেশি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি ৬৫ কেজি খাদ্যপণ্যের অপচয় হতো। ২০২৪ সালে তা বেড়ে জনপ্রতি ৮২ কেজিতে ঠেকেছে। খাদ্য অপচয়ের এই পরিমাণ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের চেয়ে বেশি। একজন ব্যক্তি বছরে গড়ে যুক্তরাজ্যে ৭৬ কেজি, চীনে ৭৫ কেজি, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ কেজি, ভারতে ৫৫ কেজি, জাপানে ৩৮ কেজি ও রাশিয়ায় ৩৩ কেজি খাদ্য অপচয় করে। জনপ্রতি অপচয়কারী দেশের তালিকায় সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন নির্দেশ করা হয়নি প্রতিবেদনে। তবে দেশের জনসংখ্যা হিসেবে সবচেয়ে বেশি অপচয়কারী দেশ চীন, সর্বনিম্ন ঘানা।
এখন বুফে রেস্তোরাঁয় প্রতি বেলায় প্লেটে অর্ধেক খাবার নষ্ট পাওয়া যায়, সেসব ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ধনী ও পর্যটন এলাকায় এ খাদ্য অপচয়ের সংস্কৃতি মারাত্মক আকার নিচ্ছে।- বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান
এ বছর বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা ও পরিবহনজনিত কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের মধ্যে গড়ে ৩৪ শতাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। নষ্ট বা অপচয় হওয়া এ খাদ্যপণ্যের আর্থিকমূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার পায় না।
আরও পড়ুন
অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার কী করেন
খাবার অপচয় বন্ধ করবেন যেভাবে
খাবার নষ্ট ও অপচয় না করা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা
বাংলাদেশে খাবার অপচয় করার মতো পরিবার আসলে কারা?
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত ‘শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে: বাংলাদেশে একটি টেকসই খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে উৎপাদিত খাদ্যের ২৭ শতাংশই খাবার টেবিলে আসে না। মোট আবাদ হওয়া জমির মধ্যে ২৭ শতাংশ বা ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটারে উৎপাদিত খাদ্য শেষ পর্যন্ত অপচয় হচ্ছে প্রতি বছর। এ কারণে বড় ধরনের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বাংলাদেশকে।
সব ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতার দারুণ অভাব রয়েছে। ভোক্তাদের বাজার থেকে অতিরিক্ত খাদ্য ক্রয়, খাদ্য সংরক্ষণের জ্ঞানের অভাবে আমাদের খাদ্য অপচয় বেশি হয়।- কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম
এ গবেষণার তথ্য বলছে, বেশিরভাগ খাদ্য অপচয় হয় উৎপাদন, পরিবহন, পরিচালনা, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়। কয়েকটি ফসলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, প্রতি বছর ২৩ শতাংশ চাল, ২৭ শতাংশ মসুর ডাল, ৩৬ শতাংশ মাছ এবং ২৯ শতাংশ আম নষ্ট বা অপচয় হয়। এছাড়া ধানের ২৩-২৮ শতাংশ, ফসল কাটার পরে গমের সাড়ে ১৭ শতাংশ, উদ্যানজাত ফসলের মধ্যে কলার ২০ শতাংশ, আলুর ২২ শতাংশ, গাজরের ২৭ শতাংশ ও টমেটোর ১০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে।
বেশি অপচয় দুই ভাবে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একধরনের খাদ্যের অপচয় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সেটা হলো ভোগের উপযোগী খাদ্যসামগ্রী না খেয়ে ফেলে দেওয়া বা নষ্ট করা।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ধারণা করি, অভিজাত রেস্তোরাঁয় ২০ শতাংশ খাবার নষ্ট হয়। ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় কম হলেও সে পরিমাণও নগণ্য নয়। ভোগের উপযোগী এসব খাদ্য ক্রেতারা কিনেও নষ্ট করছেন অসতর্কতা ও স্বভাবের কারণে- এটা খুব দুঃখজনক।’
খাদ্য অপচয় রোধে দেশে আইন থাকা দরকার। বিশ্বের কিছু দেশে এমন আইন রয়েছে, যেখানে খাদ্য অপচয়ের কারণে জরিমানা করা হয়।- কমিউনিটি সেন্টার মালিক সাজ্জাদুর রহমান
এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘বিশেষ করে এখন বুফে রেস্তোরাঁয় প্রতি বেলায় প্লেটে অর্ধেক খাবার নষ্ট পাওয়া যায়, সেসব ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ধনী ও পর্যটন এলাকায় এ খাদ্য অপচয়ের সংস্কৃতি মারাত্মক আকার নিচ্ছে। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী নষ্ট করা বা ফেলে দেওয়ার কারণে একদিকে দেশে খাদ্য সংকট বাড়ছে, অন্যদিকে প্রচুর অর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।’
ঢাকার একটি অভিজাত কমিউনিটি সেন্টারের স্বত্বাধিকারী সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘রেস্তোরাঁর চেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় কমিউনিটি সেন্টারে। কখনো এক-তৃতীয়াংশ খাবারও নষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে পার্টি বা দাওয়াতে আসা মানুষজন খাবার অপচয়ের বিষয়ে প্রচণ্ড উদাসীনতার পরিচয় দেন। এছাড়া অব্যবস্থাপনার কারণে অনুষ্ঠানগুলোতে খাবার নষ্ট হয়। একসঙ্গে অনেক অতিথির চাপ এবং খাদ্য সরবরাহে শৃঙ্খলার ঘাটতি হলে খাবার নষ্ট হয়।’
খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণ বা বিপণনব্যবস্থায় খাদ্যের যে ঘাটতি বা ক্ষতি হয়, সেটাকে খাদ্যের ক্ষয়-ক্ষতিজনিত অপচয় বা পোস্ট হারভেস্ট লস বলা হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যশস্য, মসলা ও ফলমূলের ১০টি পণ্যের পোস্ট হারভেস্ট লস প্রায় পাঁচ লাখ টন বলে এক গবেষণায় উঠে আসে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা (বিনা) এবং যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এএন্ডএম ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির যৌথভাবে করা ‘দ্য ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর দ্য এস্টাবলিশমেন্ট অব এন ই-বিম/এক্সরে ফ্যাসিলিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশে পেঁয়াজে ২০-২৫ শতাংশ, আমে ৩০-৩৫ শতাংশ, কলা, পেঁপে, পেয়ারা ও লিচুতে ২৫-৩০ শতাংশ, চালে ৮-৯ শতাংশ, ডালে ৬-৭ শতাংশ, আলুতে ১০ শতাংশ এবং আদায় পোস্ট হারভেস্ট লস ৫-৭ শতাংশ।’
ওই গবেষণার সময় বিনার মহাপরিচালক ছিলেন ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো কৃষিপণ্যে আমাদের পোস্ট হারভেস্ট লস ৩০-৪০ শতাংশ। ফলে আমরা কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়াচ্ছি, তবে খাদ্যের নিরাপত্তা বাড়ছে না। রপ্তানির বাজার আছে, অথচ আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে।’
ক্ষয়-ক্ষতিজনিত অপচয়ের বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র। এখানে খাদ্যের পচনশীলতা তুলনামূলকভাবে বেশি। খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা সেকেলে। পরিবহনব্যবস্থায় শীতল শৃঙ্খল প্রায় অনুপস্থিত। পাশাপাশি সরকারি দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত কোল্ডস্টোরেজের অভাব, বাজারজাতকরণে কার্যকর অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে। যে কারণে মাঠ থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত প্রচুর খাদ্য নষ্ট হচ্ছে।’

‘উৎপাদন পর্যায়ে মাঠের ফসলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ফসল সংগ্রহ, মাড়াই, ঝাড়াই, প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাতকরণ ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। সেসব বিষয়ে উৎপাদক প্রক্রিয়াজাতকারী ও সরবরাহকারীদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতার দারুণ অভাব রয়েছে। ভোক্তাদের বাজার থেকে অতিরিক্ত খাদ্য ক্রয়, খাদ্য সংরক্ষণের জ্ঞানের অভাবে আমাদের খাদ্য অপচয় বেশি হয়।’
অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এ উভয় ক্ষেত্রে অপচয় মাত্রাতিরিক্ত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে খাদ্যসামগ্রী মানুষের খাদ্যের পরিবর্তে অন্য বিকল্প কাজে লাগানোর প্রবণতা কম। যেমন হাঁস-মুরগি-গবাদিপশুর খাবার, মাছের খাবার তৈরি করা, জৈবসার বানানোর কাজে লাগানো মাধ্যমে খাদ্যের অপচয় রোধে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
আইন থাকা দরকার
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান ও কমিউনিটি সেন্টারের মালিক সাজ্জাদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, খাদ্য অপচয় রোধে দেশে আইন থাকা দরকার। বিশ্বের কিছু দেশে এমন আইন রয়েছে, যেখানে খাদ্য অপচয়ের কারণে জরিমানা করা হয়।
তবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ বর্তমান সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক জাকারিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দেশে কী পরিমাণ খাদ্য অপচয় হচ্ছে সে পরিসংখ্যান বা সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। সে বিষয়ে একটি পরিসংখ্যান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো করছে। সেটা পাওয়ার পরে মাত্রাতিরিক্ত অপচয় রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এখনই আইন বা জরিমানার উদ্যোগ নেই।’
তবে শুরু থেকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাদ্য অপচয় কমাতে নানান ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম

11 hours ago
7









English (US) ·