মাদকের ভয়াল ছোবলে শিশু-কিশোর

3 weeks ago 17

ড.ফোরকান আলী
পুরান ঢাকায় মাদকাসক্ত পুত্রের হাতে খুন হয়েছেন এক বৃদ্ধ পিতা। গোবিন্দ দাস লেনের একটি বাসায় এ ঘটনা ঘটে। বংশাল থানা পুলিশ জানায়, নিহত ব্যক্তির নাম নুরুল ইসলাম (৮৫)। আর ঘাতক সন্তান হচ্ছে মামুন (৪০)। দীর্ঘদিন ধরে মামুন মাদকাসক্ত। তার কারণে পরিবারের অশান্তি বিরাজ করছে। মাদক সেবনের জন্য টাকা না পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা মামুনের স্বভাবে পরিণত হয়। টাকার জন্য মামুন বৃদ্ধার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে মামুন পিতার গলা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

এসব কী মাদক! যা সেবনের জন্য জম্মদাতা বাবা মাকে খুন করে। কীভাবে শিশু কিশোররা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নিম্নের কেইস ষ্টাডি থেকে কিছু অনুমান করা যাবে। আমাদের দেশের বিশেষ করে পথ শিশুসহ সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুরা কীভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তার করুণ চিত্র।

কথা হলো সেন্টু মিয়া নামের এক ১৩ বছরের কিশোরের সঙ্গে। তার আসল নাম অবশ্য অন্য একটা। তবে সবাই ডাকে সেন্টু মিয়া। থাকে টিচার কোয়ারটারের শেষ মাথায় নীলক্ষেতে ডাস্টবিনের পাশে। ফুটপাতে ঘুমায় সবাই একসঙ্গে চিপাচিপি করে। জানতে চাইলাম, তোমার বাড়ি নেই? মা-বাবা নেই?।

সেন্টুর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বরে। সে সময় তার সঙ্গে ছিল আরও দুই কিশোর। তারা সবাই মাদকাসক্ত। ওরা বলে, ‘গাঁজার পরে ড্যান্ডিও লইছি। এখন গাঁজা কম খাই। ড্যান্ডিই লই বেশি। ড্যান্ডি হইল জুতার পেস্টিংয়ের আঠা! ‘কোথায় পাও এসব?’ ‘হাতিরপুলের জুতার কারখানা থেইক্যা কিনি। ৬৫ টেকায় এক ডিব্বা পাই। ড্যান্ডি লইতে লইতে মনে হয়, কইলজ্যাটা এতো দিনে পেলাসটিক হইয়্যা গেছে গো। পরথমে বন্ধুদের কাছ থেইকা লইয়া সিগারেট খাইছি। হের বাদে গাঁজা আর মদ খাওয়া ধরছি। খুব মজা লাগে খাইতে। কথাগুলো বলছিল নয়ন নামে ১৩ বছরের এক কিশোর।

নয়নের বাড়ি ফরিদপুরে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সে দুই বছর আগে ঢাকা চলে আসে। থাকে কারওয়ান বাজার বস্তিতে। এক ট্রাক চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন ২০০ টাকা পায়। প্রায় সব টাকাই গাঁজা ও মদের পেছনে খরচা হয়ে যায়। নয়ন জানায়, পড়ালেখা আর ভালা লাগে না। গাঁজা আর মদই ভালা। নয়নের মতো কবীরও মাদকে আসক্ত। কবীর (১৫) থাকে মা-বাবার সঙ্গে কারওয়ান বাজার বস্তিতে। এক সময় গাঁজা বহনের কাজ করতো। অন্যদের দেখাদেখি সে প্রায় তিন-চার বছর আগে গাঁজা সেবন শুরু করে। এখন মাঝেমধ্যে মদ আর ইয়াবাও গ্রহণ করে।

নয়ন ও কবীরের সঙ্গে দেখা হয় কারওয়ান বাজার রেলগেটের পাশে বালুর মাঠে লেকের পাশে। সেখানে এই দুই শিশুসহ বেশ কয়েকটি শিশু গোল হয়ে বসে গাঁজা সেবন করছিল। এদের মতো দেশে বহু শিশু মাদকে আসক্ত। তবে এদের সঠিক সংখ্যা অজানা। এসব শিশু গাঁজা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, সীসা, ড্যান্ডি, ইয়াবা, পেথিড্রিন ইত্যাদি মাদকে আসক্ত। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণের কারণে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ঝরে পড়ছে বিদ্যালয় থেকে।

দেখা গেছে, ড্যান্ডি নামে নতুন ও সহজলভ্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে পথশিশুরা। ড্যান্ডি এক ধরনের আঠা, যা মূলত সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে একটি উপাদান আছে। টলুইন মাদকদ্রব্যের তালিকায় আছে। এটি জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার-টিউব লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি খেলে ক্ষুধা হয় না ও ব্যথা লাগে না। দীর্ঘমেয়াদে খেলে মস্তিষ্ক, যকৃত ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শুধু বস্তি বা পথশিশুই নয়, মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুরাও। বনানী, গুলশান, ধানমন্ডির বেশ কয়েকটি খাবারের দোকানের আড়ালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সীসা গ্রহণ করে। ছেলে শিশুদের পাশাপাশি বহু মেয়েশিশুও মাদকে আসক্ত। এদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডেলেসেন্ট (এমএআরএ) নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার লাখ ৪৫ হাজার পথশিশু আছে। এদের মধ্যে রাজধানীতে থাকে তিন লাখেরও বেশি পথশিশু। এদের বেশিরভাগই মাদকে আসক্ত। কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক মনোরোগ চিকিৎসকক বলেন, মাদক গ্রহণকারীর বয়স যতো কম হবে, তার ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে। সেক্ষেত্রে শিশুদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। মাদক নেওয়ার কারণে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ বিঘ্নিত হয়। পরিকল্পনা গ্রহণে সমস্যা হয়। লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। সামাজিকীকরণে সমস্যা হয়।

তবে মাদকাসক্ত শিশুদের ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য, সেটি সময়সাপেক্ষ। শিশুদের আলাদা স্থানে আলাদাভাবে নিরাময় করতে হবে। বড়দের সঙ্গে রাখলে উল্টো ফল হতে পারে। চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একবার সীসা গ্রহণে যে পরিমাণ নিকোটিন শরীরে যায়, তা ১০০টি সিগারেটের সমপরিমাণ। সীসা সিগারেটের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর।

মনোরোগ চিকিৎসক ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের বহু শিশু এখন মাদকাসক্ত। সমাজের সব শ্রেণির শিশু এই ভয়াল নেশার ফাঁদে আটকা পড়েছে। এটি থেকে তারা বের হতে পারছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলেন, ‘বাংলাদেশে কতো শিশু মাদকাসক্ত, এর পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। তবে পথশিশুদের মাদকাসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে অধিদপ্তরে শিশুদের আলাদা একটি ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কাজ চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, শিশুরা যাতে ড্যান্ডি ব্যবহার না করে, সেজন্য একটি আইন করার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইন প্রণয়নের পর যারা এগুলো মাদক হিসেবে ব্যবহার করবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া সীসাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে গণ্য করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, শিশু-কিশোরদের মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল সম্ভব গাঁজা সীসা, ড্যান্ডি, ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক থেকে আমাদের শিশুরা মুক্ত হবে।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

কেএসকে/জেআইএম

Read Entire Article