মাদারীপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ

5 days ago 7

একসময় দক্ষিণ জনপদের রাজৈর উপজেলার মাচ্চর গ্রামে বিশাল এলাকাজুড়ে ছোট-বড় অনেক বাঁশঝাড় নজরে পড়তো। ঝাড়গুলোতে বাঁশের ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে, সূর্যের আলো পর্যন্ত অনেক সময় বাঁশঝাড়ের মাটি স্পর্শ করতে পারতো না। নানা জাতের পশু-পাখিও বাস করতো এসব বাঁশঝাড়ে। যে কারণে দিনের বেলায়ও অনেকে বাঁশঝাড়ের ভেতরে ঢুকতে সাহস পেতেন না। বাঁশের ঘনত্বে ঘন অন্ধকারের জন্য গা ছমছম করে উঠতো। তবে এখন আর আগের মতো বাঁশঝাড়ের গাঢ় অন্ধকার চোখে পড়ে না। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশঝাড়।

শুধু রাজৈরের মাচ্চর গ্রামেই নয়, মাদারীপুর জেলার গ্রামে গ্রামে ছিল ছোট-বড় বাশঁঝাড়। দিনে দিনে তা হারিয়ে যাচ্ছে। লোকজন জীবনের তাগিদে বন-জঙ্গল ও বাঁশঝাড় কেটে নানান স্থাপনা নির্মাণ করছেন। ফলে প্রকৃতির আদি নিদর্শন এই বাঁশঝাড় দিনে দিনে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত গৃহ নির্মাণ, আবাদি জমিতে পরিণত করা, বাঁশ শিল্পীদের পেশা পরিবর্তন, বাঁশের তৈরি আসবাবপত্রে চাহিদা কমে যাওয়া, প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা বৃদ্ধিসহ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী বাঁশঝাড়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে।

রাজৈর উপজেলার মাচ্চর গ্রামের বাঁশঝাড়ের মালিক দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাপ-দাদারা এই বাঁশ লাগিয়েছিলেন। এই ঝাড় থেকে অনেক বাঁশ বেচেছি। সপ্তাহে হাটের দিন ৩০-৪০টি করে বেঁচে টাকা আয় করেছি। তবে দিন দিন ঝাড় কমে এখন ছোট হয়ে গেছে। বংশের লোকজন বাশঝাঁড় কেটে বাড়ি তুলেছেন।’

মাদারীপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ

তিনি আরও বলেন, ‘আগে বাঁশঝাড়ের মাঝখানে যেতে ভয় পেতাম। বাঁশ আর বাঁশে অন্ধকার হয়ে থাকতো। এখন সবখানে ফাঁকা।’

মাদারীপুর সদর উপজেলার বকুলতলা বাজারের বিক্রেতা সেকান্দার আলী বলেন, ‌‘আগে অনেক বাঁশ পাওয়া যেতো, দামও ছিল কম। অল্প দামে বাঁশ কিনে কুলা, চালুনি, ডালি, ঝুড়ি বানাতাম। পরে তা হাটে হাটে বিক্রি করতাম। তবে এখন আগের মতো বাঁশ পাওয়া যায় না। আর যা পাওয়া যায় দামও অনেক বেশি। বেশি দামে বাঁশ কিনে জিনিস তৈরি করলে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এতে করে ক্রেতারা কিনতে চায় না।’

আরও পড়ুন:
বিলুপ্তির পথে ২০০ বছরের মাদুলি শিল্প
পাবনায় ক্রমাগত লোকসানে বিলীন হচ্ছে তাঁত
কাঁসার ব্যবসা এখন ‘অনুষ্ঠান নির্ভর’

মাদারীপুর শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময় আমার এই বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড় ছিল। এখন আর সেই ঝাড় নেই। তবে এখনো অল্প কিছু বাঁশ আছে। তাও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে।’

মাদারীপুরের স্থানীয় সংগঠন সেবা উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক ময়না আক্তার বলেন, ‘দিনে দিনে বাঁশঝাড় কমে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো আগের মতো বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র এখন আর কেউ ব্যবহার করেন না। বাঁশের তৈরি জিনিসের পরিবর্তে এখন প্লাস্টিকের জিনিসপত্রই মানুষের নজর কাড়ছে। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের চেয়ে প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের দামও কম, দেখতেও সুন্দর ও আধুনিক।’

তবে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র যেমন-ডালি, চালুনি, ঝুড়ি, কুলা, পাটি, মাছ ধরার চাইসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদা এখনো আছে বলে জানান ময়না আক্তার। তিনি বলেন, বাঁশ শিল্পীরা পেশা পরিবর্তন করায় বাঁশের তৈরি এসব জিনিসপত্র এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। বাজারেও তেমন একটা পাওয়া যায় না।

মাদারীপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস জানান, একসময় গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের গৃহস্থালীর ব্যবহারের জিনিসপত্রের মধ্যে বাঁশই ছিল প্রধান। গ্রামের প্রায় শতকরা ৫০ জন মানুষই বাঁশের বাড়িঘর নির্মাণ করে থাকতেন। বিশেষ করে ঘরের খুঁটি, বেড়া ইত্যাদি তৈরি হতো বাঁশ থেকে। বাঁশের ঘর আরামদায়ক ও ভূমিকম্পরোধক। বাঁশের ঘর তৈরিতে খরচও অনেক কম। পরিত্যক্ত বাঁশ উন্নতমানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বাঁশগাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।

দিনে দিনে মাদারীপুর থেকে বাঁশঝাড় কমে যাচ্ছে বলে স্বীকার করেন সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আল-আমিন।

তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও বেশ বড় বড় বাঁশঝাড় চোখে পড়তো। সময়ের স্রোতে তা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ বাঁশগাছ কেটে সেই জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছেন। তাছাড়া আগের মতো বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রও মানুষ তেমন একটা ব্যবহার করেন না। সবমিলিয়ে দিন দিন বাঁশঝাড় হারিয়ে যাচ্ছে। বাঁশগাছ রক্ষায় সবার এগিয়ে আসতে হবে।’

এসআর/এএসএম

Read Entire Article