মানসিক ভারসাম্য হারালেও কোরআন ভুলে যাননি রাশিদুল

2 weeks ago 7

দুষ্টুমি করায় আঘাত করেন বাবা। সেই আঘাতে মানসিক ভারসাম্য হারায় হাফিজিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নরত ছেলে। ভারসাম্য হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ালেও মুখস্ত করা কোরআন ভুলেননি। ভবঘুরে যুবকের কণ্ঠে সুমধুর তেলাওয়াত মুগ্ধ করে সবাইকে।

এ গল্প গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রাশিদুল ইসলামে। বাবা মৃত জবেদ আলী ও মা রাশেদা বেগমের ছেলেমেয়ের মধ্যে রাশিদুল বড়।

জানা যায়, আশির দশকের শেষভাগে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভিটেমাটি ভেঙে উলোট-পালোট করে দেয় সর্বনাশী তিস্তা। ভাঙনের কবলে পড়ে জীবিকার তাগিদে এলাকা ছাড়েন জবেদ। সঙ্গী হন স্ত্রী রাশেদা ও রাশিদুলসহ তিন শিশু সন্তান। কাজের সন্ধানে যান শহরে।

রিকশা চালিয়ে দুঃখকষ্টে দিন গেলেও বাবা জবেদ আলী ও মা রাশেদা বেগম রাশিদুলসহ তিন ছেলেকেই ভর্তি করিয়েছিলেন সেখানকার একটি হাফেজিয়া মাদরাসায়। তাদের স্বপ্ন ছিল ছেলেদের হাফেজ বানানোর।

মা-বাবার সেই স্বপ্ন পূরণে কয়েক পাড়া কোরানও মুখস্থ করেছিলেন রাশিদুল। একদিন সকালে বাসায় দুষ্টুমি করছিল ছোট্ট রাশিদুলসহ অপর দুই ভাই। ছেলের দুষ্টুমি সইতে না পেরে রাশিদুলের পিঠে পিঁড়ি দিয়ে আঘাত করেন। কিন্তু পিঠে না লেগে আঘাত লাগে মাথায়। বাবার সেই সামান্য আঘাতই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ছেলের জীবনে। চিকিৎসা করালেও মানসিক ভারসাম্য হারান রাশিদুল। পরে পাঠানো হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালেও। সেখানে কয়েকমাস চিকিৎসার পর ভালো হয়ে যান তিনি। ওষুধ সেবন করালে ভালো থাকে, সেবন বন্ধ করলে দেখা দেয় আবার ভারসাম্যহীনতা।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভারসাম্যহীন রাশেদ ফজরের নামাজের পর যখন যেখানে পারেন বসে যান সঙ্গে থাকা একটি ছেঁড়া কোরআন নিয়ে। তার সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরানের তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হন সবাই। মীরগঞ্জ বাজারের পূর্বধারে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস তার। ভেতরে থাকা টেবিলে রাখা আছে সেই কোরআন। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি পথেই ঠিকানা রাশিদুলের। যত রাতেই বাড়িতে ফিরুক মায়ের রেখে দেওয়া খাবার খেয়ে আবার কোরআন পড়া শুরু করেন তিনি। পাঠ শেষে ছেঁড়া মশারির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন।

মানসিক ভারসাম্য হারালেও কোরআন ভুলে যাননি রাশিদুল

রাশিদুল ভারসাম্যহীন হলেও কারও কোনো ক্ষতি করে না জানিয়ে তার ছোট ভাই মাসুদ বলেন, আমার বড় ভাই রাশিদুলের এ দুরবস্থা দেখে খুবই কষ্ট হয়। তার চিকিৎসা করানোটাও জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে তা করতে পারছি না।

ছেলের এমন ভারসাম্যহীনতায় ভেঙে পড়েছেন বৃদ্ধ মা রাশেদা বেগম। তিনি বলেন, নদী ভাঙনের পর দিনাজপুরের পার্বতীপুরে যাই। সেখানে ৩ ছেলেকে হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়তে দেই। একদিন মারামারি করছিল তিন ভাই। ওর বাবা দুষ্টুমি সইতে না পেরে পিঁড়ি দিয়ে পিঠে মার দেয় রাশিদুলের। সেই থেকে তার এই অবস্থা। কিন্তু পয়সার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছি না ঠিকভাবে।

প্রতিবেশী জবেদ আলী বলেন, রাশিদুলকে পাবনায় নিয়ে গিয়েছিলেন তারা। ওষুধ খেলে ভালো থাকেন, না খেলে আবার আগের মতো হয়।

আগের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পাবনা মানসিক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মাসুদ রানা সরকার। মুঠোফোনে তিনি বলেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা কখনো বন্ধ করা যাবে না।

আর্থিক সহায়তা পেলে হয়ত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন ও সেবাযত্ন পেলে সুস্থ হবেন তিনি। সুস্থ হয়ে সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত করার পাশাপাশি অন্যদেরও কোরআন শেখাবেন রাশিদুল, এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

আনোয়ার আল শামীম/এমএন/জিকেএস

Read Entire Article