মানুষের জীবনে নামের প্রভাব পড়ে
নাম মানুষের পরিচিতির মাধ্যম। পৃথিবীতে এমনকি পরকালেও এ নামের মাধ্যমেই প্রত্যেক মানুষ সম্বোধিত হয় এবং হবে। তাই ইসলামে নাম খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাম ও পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান একই সঙ্গে নিজেকে মুসলমান এবং বাঙালি ভাবতে চায়। ফলে কেউ কেউ আরবি নাম রাখেন, আবার কেউ কেউ বাংলা নাম রাখেন। অনেকে আবার নামের একাংশ আরবি ও অন্য অংশ বাংলায় রাখেন। প্রশ্ন হলো—আরবি নামগুলোই কি শুধু ইসলামি নাম? আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শব্দের নাম কি ইসলাম সমর্থন করে না?
নামের বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা হলো, অর্থবোধক সুন্দর নাম রাখতে হবে। সেটা আরবি হোক বা বাংলা। সব আরবি নাম ইসলামী নাম নয়। আবার অন্য ভাষায় অর্থবোধ সুন্দর নামগুলোও ইসলামবিরোধী নয়। মূলত কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত সুন্দর অর্থবোধক নামগুলোই প্রাধান্য পাবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে। আবু দাউদের ৪৩০০ নম্বর হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন তোমাদের নিজ নাম ও পিতার নামে ডাকা হবে। তাই তোমরা সুন্দর নাম রাখো।’
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মুসলমান সন্তানের নাম আরবিতে রাখেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আরবি ভাষায় নাম রাখা হলে মুসলমানদের ভাষাকেন্দ্রিক একটি ঐক্য গড়ে ওঠে এবং মুসলিম হিসেবে পরিচয় সহজভাবে প্রকাশ করা যায়। তা ছাড়া কোরআনে আরবিতে বহু নামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা আরবিতে নাম রাখলে সহজে মেলানো যায়। অন্যদিকে অনেকে বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য মাতৃভাষায় ডাক নাম ব্যবহার করে থাকেন। কেউ চাইলে নিজ ভাষায় নাম রাখতে পারেন, তবে সেটা হতে হবে সুন্দর, অর্থবহ, ইসলাম ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভিনধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা।
আরবে অনেক অনারব সাহাবির নাম আল্লাহর রাসুল (সা.) স্বাভাবিক চোখেই দেখেছেন। বিভিন্ন সৃষ্টিরাজির নামে অনেক সাহাবির নাম ছিল। সেগুলোও আল্লাহর রাসুল পরিবর্তন করেননি। যেমন— জুনদুব অর্থ প্রজাপতি, আসাদ অর্থ সিংহ, তালহা অর্থ উদ্ভিদ, জাবাল অর্থ পাহাড়, সালাম অর্থ শান্তি। অনেক সাহাবি এসব নাম ধারণ করেই জীবন সমাপ্ত করেছেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে, নামের অর্থ যেন অসুন্দর না হয়। কারণ নামের একটা প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে। নাম সুন্দর হলে মানুষের ব্যক্তিচরিত্রও সুন্দর হয়। নাম খারাপ হলে এ খারাপের প্রভাব তার জীবনাচারেও পড়ে। সহিহ বোখারিতে ৬১৯৩ হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল হুমাইদ বিন শায়বা বলেন, আমি হজরত সাইদ ইবনুল মুসাইয়েবের (রহ.) কাছে বসা ছিলাম। তিনি তখন বললেন, আমার দাদা ‘হাজান’ একবার নবীজির দরবারে উপস্থিত হলেন। নবীজি (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী? দাদা বললেন, আমার নাম হাজান। (হাজান অর্থ শক্ত ভূমি) নবীজি (সা.) বললেন, না, তুমি হচ্ছো ‘সাহল’ (অর্থাৎ তোমার নাম হাজানের পরিবর্তে সাহল রাখো; সাহল অর্থ নরম জমিন)। দাদা বললেন, আমার বাবা আমার যে নাম রেখেছেন, আমি তা পরিবর্তন করব না। সাইদ ইবনুল মুসাইয়েব (রহ.) বলেন, এর ফল এই হলো যে, এরপর থেকে আমাদের বংশের লোকদের মেজাজে রূঢ়তা ও কর্কশভাব রয়ে গেল।
অহংকার ও নিজের বড়ত্বের দিকে ইঙ্গিত থাকায় নবীজি (সা.) কিছু কিছু নাম অপছন্দ করতেন। সহিহ বোখারির ১৪০৩ নম্বর হাদিসে এসেছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হবে ওই ব্যক্তির নাম, যে মালিকুল আমলাক (রাজাধিরাজ) নাম ধারণ করেছে। আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত বাদশাহ আর কেউ নেই।’ এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়—শাহজাহান, শাহআলম, সম্রাট, রাজা, রাজাধিরাজ, রাজেশ্বর, রানি, সম্রাজ্ঞী, মহারাজ, শাহনাজ, শাহানা ইত্যাদি নাম রাখা উচিত নয়। যে নামের ভেতর ঔদ্ধত্য ও অহমিকা প্রকাশ পায়, আল্লাহর নামের স্তরের কাছাকাছি মিলে যায়, এ ধরনের নাম রাখা অনুচিত। বরং যে নামে আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামি প্রকাশ পায়, বিনয় ও কোমলতা প্রকাশ পায়, এমন নাম রাখা চাই। নাম নিছক আবেগ ও পছন্দের জিনিস নয়। একটা শব্দ পছন্দ হলো বা ভালো লাগল, সেটাই নিজের সন্তানের জন্য নির্ধারিত করে ফেললাম, বিষয়টা যেন এমন না হয়। বরং অভিজ্ঞ আলেম ও মুসলিম স্কলারের পরামর্শ নিয়ে নাম রাখা চাই।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক