জেনিস ফারজানা তানিয়া এলএলবি পাশ করে হয়েছেন একজন দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা। তিনি যশোরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আধুনিক ফ্যাশনের অনুসঙ্গ করেছেন যশোর স্টিচের শাড়ি, পাঞ্জাবি, শাল ও সালোয়ার কামিজ। যারা ঐতিহ্যকে ধারণ করেন এবং আধুনিকতাকে ভালোবাসেন তাদের জন্যই জেনিস ফারজানার আলিয়া’স কালেকশন।
জেনিস ফারজানার এগিয়ে চলা, প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর গল্প জানতে চাই?
জেনিস ফারজানা: আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন আমার মা। তার মৃত্যুতে আমি খুবই ভেঙে পড়েছি। সবকিছু থাকার পরও যেন একাকিত্ব আমাকে ছাড়েনি। তাই মায়ের নামেই একটা ফেসবুক পেজ খুলেছিলাম ২০১৬ সালে। মূলত একাকিত্ব দূর করতেই। পরে ২০১৭ সালের দিকে মাথায় আসলো অনলাইনে কাজ শুরু করতে পারি। তাহলে আমার মায়ের নাম আমিসহ বহু মানুষের মুখেমুখে থাকবে। তাই ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে শাড়ি, শাল ও থ্রিপিস দিয়ে শুরু হয় আমার যাত্রা। এখন যশোর স্টিচ পণ্যের জন্য আলিয়া’স কালেকশন একটি পরিচিত ব্র্যান্ড। আমাদের রয়েছে একদল নারীকর্মী যারা যশোরের প্রত্যন্ত এলাকায় থেকেই ঐতিহ্য, আধুনিকতার মিশেলে বুনে যাচ্ছেন বৈচিত্রময় পোশাক।
জাগো নিউজ: পোশাক নিয়ে কেনো কাজ করছেন?
জেনিস ফারজানা: আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে পোশাক। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা-ই ব্যবহার করি না কেন, পোশাক ছাড়া আমাদের একটা মুহূর্তও চলে না। তাই আমার উদ্যোগে পরসা সাজিয়েছি এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটি।
জাগো নিউজ: যশোর স্টিচ পণ্য কেনো?
জেনিস ফারজানা: আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়ার বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে মাগুরায়। তাই ছোটবেলা থেকেই যশোর স্টিচ পণ্য ব্যবহার করে বড় হয়েছি। যশোর স্টিচ পণ্যের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে আধুনিক স্টাইলে ক্রেতাদের মন জয় করতে এবং এই ঐতিহ্যকে আরেকটু এগিয়ে নিতে স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি সন্তুষ্ট আমার প্রতিটি অগ্রগতিতে।
জাগো নিউজ: কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
জেনিস ফারজানা: রিমোট এরিয়ার মেয়েদের আমার মতো করে কাজ শিখিয়ে নিয়মিত সবাইকে ধরে রাখতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আমি যেই স্টাইলে কাজ করি তা অন্য কেউ চাইলেও হঠাৎ করে বুঝতে পারবে না। আমাদের মেয়েরা তাদের পরিবার সামলানোর পাশাপাশি কাজ করে তাই মাঝেমাঝে তারা কাজে যোগ দিতে পারে না। এ কারণে কর্মী সংখ্যা বাড়িয়েছি যেন এক সঙ্গে ৫ জন কাজে উপস্থিত থাকতে না পারলেও অসুবিধা না হয়।
শুরুতে আমার উদ্যোগ ছিল সম্পূর্ণ ফেসবুক নির্ভর। কিন্তু ক্রেতাদের অনেকেই আছেন যারা ফেসবুকের বাহিরে কেনাকাটা করেন। তারা একসঙ্গে সব পণ্য দেখতে চান। লক্ষ্য করে দেখলাম, একদল ক্রেতা আছেন যারা ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জিজ্ঞেস করার চেয়ে একসঙ্গে তথ্য উপাত্ত দেখেই পণ্য কিনে পেলেন। তাই ঐ ধরনের ক্রেতাদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা আলিয়া’স কালেকশনের ই-কমার্স ওয়েবসাইট লঞ্চ করেছি। যেখানে আমাদের সবগুলো পণ্য আপলোড হচ্ছে। ক্রেতারা নিয়মিত আসতে পারে, দেখতে পারে এবং তাদের পছন্দ হলে অর্ডার করে ফেলতে পারে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই।
আরও পড়ুন
জাগো নিউজ: দেশের প্রেক্ষাপটে উদ্যোগের জন্য ওয়েবসাইট থাকা কতটুকু প্রাসঙ্গিক?
জেনিস ফারজানা: উদ্যোগের জন্য একটা ওয়েবসাইট থাকা আবশ্যক। ই-কমার্স ওয়েবসাইট না হলেও অন্তত একটা ব্লগ সাইট রাখা দরকার। যেখানে ক্রেতাদের রিভিউগুলো আপলোড হবে এবং কিছু টিপস অ্যান্ড ট্রিকস শেয়ার হবে। এতে ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে, গুগলে র্যাংক হয়, পরিচিতি দেওয়া ফলপ্রসূ হয়। আর সেখানে পণ্য রাখতে পারলে অপরিচিত ক্রেতাদের সমাগম হয়। যা আমাদের স্বপ্নকে এগিয়ে নেয় এবং মার্কেট এরিয়া বড় করে।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে ফেসবুকে একই নামে একাধিক পেজ, গ্রুপ থাকে যেহেতু তা বিনামূল্যে তৈরি করা যায়। কিন্তু ওয়েবসাইট একই নামে একাধিক খুঁজে পাওয়া কঠিন।
জাগো নিউজ: পোশাক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন কি না?
জেনিস ফারজানা: আমাদের প্রতিটি পণ্যই হাতের কাজের তৈরি। তাই প্রতিটি পণ্যের নকশা হয় ইউনিক। অর্থাৎ একটার সঙ্গে একটার শতভাগ মিল থাকার সুযোগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে সুতার রং সামান্য হেরফের হয়। এসব নিয়ে আগে ঝামেলা একটু বেশি হতো। এখন আমরা শুরুতেই ক্রেতাদের বলে রাখি যে, সামান্য এদিক সেদিক হতে পারে।
কিছু পণ্যের স্টক বেশি রাখতে হয়। যেমন পাঞ্জাবি, একটা নকশায় কয়েক সাইজ ও কয়েকটি রঙের রাখতে হয়। এতে বিনিয়োগ বেশি লাগে। এরপরও অনেক সময় কষ্ট হয়ে যায় ক্রেতাদের চাহিদা মতো সাইজ ও রঙের পাঞ্জাবি সরবরাহ করতে। তাই তাদের থেকে কাস্টমাইজ অর্ডার ও সময় নিয়ে কিছুদিন পর ডেলিভারি করি।
এছাড়াও অনেকে ম্যাচিং ফ্যামেলি কোম্বো চেয়ে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী বা সন্তান সহ সবাই একই রঙের পোশাক পরিধান করতে চান উৎসব কিংবা বিশেষ দিনে। আমরা তাদের থেকে সময় চেয়ে তা করে দেই কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সময়ের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে একটু অসুবিধা হয়।
জাগো নিউজ: পোশাকের পাশাপাশি আর কি নিয়ে কাজ করছেন?
জেনিস ফারজানা: আমার উদ্যোগের প্রধান পণ্যই হচ্ছে শাড়ি। কারণ উৎসব বা বিশেষ দিনগুলো আমরা বাঙালি নারীরা শাড়ি ছাড়া উদযাপন করতে পারি না। এছাড়াও থ্রিপিচ, টুপিচ, ওয়ানপিচ, পাঞ্জাবি, শাল ও অন্যান্য এক্সেসোরিজ নিয়ে কাজ করি। সবই হাতের কাজের পোশাক। এখন যেহেতু আমাদের সক্রিয় ই-কমার্স ওয়েবসাইট আছে তাই আরও কিছু পণ্য ডিসপ্লে করবো শিগগির।
জাগো নিউজ: জিআই নিয়ে কেনো কাজ করছেন?
জেনিস ফারজানা: সমাজ কিংবা দেশের জন্য কাজ করার একটা দুর্বলতা ছোটবেলা থেকেই। যখন জানতে পারলাম জিআই পণ্য দেশের ঐতিহ্য, ব্র্যান্ডিং ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। এই পণ্যের সঙ্গে সরাসরি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি জড়িয়ে আছে তাই জিআই নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়েছি এবং কাজ করছি।
সারাদেশের ৬৪ জেলা নিয়ে একটি সম্ভাব্য জিআই পণ্যের তালিকা করেছি এবং তা আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর হস্তান্তর করেছি। এছাড়াও প্রত্যেক জেলা অনুযায়ী সম্ভাব্য জিআই পণ্যের বর্ণনা রাখার চেষ্টা করেছি আমার ওয়েবসাইটে। যেন মানুষ তার জেলার সম্ভাব্য জিআই পণ্য নিয়ে জানতে গুগলে সার্চ করলে আমার ওয়েবসাইট থেকে সেই জেলার সম্ভাব্য জিআই পণ্যগুলো নিয়ে জানতে পারে এবং তারা কাজ করতে পারে।
এই কাজ বাইন্ডিং করে একাধিক জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের হাতেও তুলে দিয়েছি। এছাড়াও মাগুরার হাজরাপুরি লিচুর জিআই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য জেলা প্রশাসক মাগুরাকে ডকুমেন্টেশন তৈরি করে দেওয়া সহ সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করেছি। এটি এখন মাগুরার স্বীকৃতি প্রাপ্ত জিআই পণ্য!
জাগো নিউজ: আপনার অনুপ্রেরণায় কে ছিলেন?
জেনিস ফারজানা: আমার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা বলতে পারেন মূলত আমার মায়ের শূন্যতা। পণ্য চয়েজের অনুপ্রেরণাও আমার বাবা মা। কারণ ছোটবেলা থেকে তারা যশোর স্টিচের পণ্য ব্যবহার করতে না দিলে হয়তো আমার এতোটা আগ্রহ জন্মাতো না। আমি যশোর স্টিচের পণ্যের মান, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা সম্পর্কে জানার কারণেই এই পণ্য নিয়ে উৎসাহিত হয়েছি। আর জিআই পণ্য নিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছি ফেসবুকে যাদের সঙ্গে একসঙ্গে চলেছি ও কাজ করেছি তাদের থেকে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
জেনিস ফারজানা: যশোর স্টিচ পণ্যের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে যত ভাবে কাজ করার সুযোগ আছে আমরা করতে চাই। এই জন্য আমরা ওয়েবসাইটে বেশি ফোকাস দিয়েছি। নতুন নতুন ডিজাইন আনার মাধ্যমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চাই। অনলাইনে আরও বেশি পরিচিতি পাওয়ার পর অফলাইনে একটা শোরুম রাখতে চাই। যেখানে আমার পণ্যগুলো সহ অন্যান্য দেশি পণ্যের উদ্যোক্তাদের জন্য একটা কর্ণার থাকবে। সেখানে কিছু উদ্যোক্তা তাদের পণ্যগুলোর পরসা সাজাতে পারবে।
আমার উদ্যোগের নামে যে ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে তা দেশি পণ্যের অন্যান্য উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছি। তারা নিজেদের মতো করে একটিভ আছে এবং তাদের পণ্যের ক্রয় বিক্রয় করছেন স্বাধীনভাবে। এমন আরও কিছু উদ্যোগ নিতে চাই যেন তাদের স্বপ্নের ভ্রমণ আরও সহজ হয়। এছাড়াও আমার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে আমার কর্মীদের সন্তানদের জন্য একটা শিক্ষা বৃত্তি চালু করা। জিআই পণ্য নিয়ে আরও বেশি কাজ করতে চাই যেন উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পর্যন্ত সবাই উপকৃত হতে পারে।
জাগো নিউজ: আপনিতো একজন সফল উদ্যোক্তা? তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
জেনিস ফারজানা: আমি সবসময় বর্তমানকে উপভোগ করি এবং পরবর্তী কাজকে ফোকাস করি। এতে করে আমার নতুন নতুন আনন্দ ও উপভোগের অসুবিধা হয় না। তাই যারা উদ্যোক্তা হতে চায় তারা নিজেদের ভালো লাগার জায়গাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে দীর্ঘ সময় লেগে থাকতে পারবে এবং যত বাঁধাই সামনে আসবে তারা মোকাবেলা করতে পারবে। নিজের স্বপ্নকে ভালো করে জানার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে বহুভাবে এবং তা খাতা কলমে থাকার চেয়ে নিজের মাথায় থাকা বেশি কার্যকরি। প্রতিদিন নতুন নতুন আইডিয়া যোগ করার প্রবণতা তৈরি করতে হবে তা হতে পারে কনটেন্ট লেখা, ডেলিভারি, কাস্টমার সার্ভিস, ডিজাইন বা ইনোভেশন নিয়ে। এই অভ্যাসটিই তাদের এগিয়ে রাখবে। আর সবসময় অর্থের লাভের চেয়ে উদ্যোগের ভ্যালু বৃদ্ধি কিংবা নেটওয়ার্কিং বাড়ানোর দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস