মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কেন এই কুতর্ক?

3 hours ago 3

সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির এমএর ছাত্র হিসেবে ড. গাবর কাদের এর কাছে গণহত্যা বিষয়ে প্রথম হাতেকলমে পাঠ পেয়েছিলাম। তিনি আমাদের Genocide and Memory in Comparative Perspective কোর্স পড়ানোর সময়ে হাতেকলমে শেখানোর জন্য হলোকাস্টের অনেক ফিল্ডে নিয়ে যান। আমি মূল্যায়নের অংশ হিসেবে কোর্স অ্যাসাইনমেন্টে “The Bengali Genocide case of East Pakistan and Rohingys Genocide Case of Arakan: A Comparative Study” শিরোনামে একটি গবেষণা পেপারও লিখেছিলাম। তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে ওই গবেষণা প্রবন্ধ লেখার প্রস্তাব অনুমোদন করেছিলেন।

ওই গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমাকে বেশ বইপত্র ঘাটতে হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের একাত্তর সালের গণহত্যা নিয়ে সাম্প্রতিক যে তর্ক-বিতর্ক চলছে সেখানে গবেষণা নির্ভর কোনো আলোচনা চোখে পড়লো না। হাস্যকরভাবে কোনো গবেষক নন এমন একজন ব্লগারের বক্তব্য নিয়ে দেশ-বিদেশ জুড়ে বাঙালিদের মধ্যে তোলপাড় চলছে। এ থেকে আমাদের অ্যাকাডেমিক পরিসর ও জনপরিসরের জ্ঞানচর্চার রুগ্নতা, মানুষের রুচিবোধ ও সংস্কৃতির চালচিত্র আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেই বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে।

শহীদের সংখ্যা দুই হাজার নাকি ত্রিশ লাখ?

একজন ব্লগারের দাবি খারিজের জন্য অ্যাকাডেমিক আলোচনার পরিসর তৈরি করা উপযুক্ত নয়। কারণ ভিডিও ব্লগ কোনো স্বীকৃত গবেষণা নয়। এছাড়া ওই ব্লগারের কয়েকটি ভিডিও আমি দেখেছি, তিনি মূলত আম-পাবলিকের রুচির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের বানর নাচ নাচাচ্ছেন। রুচিসম্মত কারোর তার ভিডিও দেখার সময় থাকার কথা নয়। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবের এই যুগে তার দাবিকৃত তথ্যের প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করছে, জনপরিসরে ভুল বার্তা যাচ্ছে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের এই বিষয়ে কথা বলতে হচ্ছে। তাছাড়া একাত্তরের গণহত্যার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বের কারণে এই বিষয়টি এত হাইপ তুলেছে যে আলোচনা না করলে সাধারণ মানুষ ভুল বার্তা পাবে।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে দুই হাজার নিহত হওয়ার দাবি তিনি একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে করেছেন। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানে যে সংবাদপত্রের তথ্যকে ঐতিহাসিক সূত্র হিসেবে গ্রহণ করতে হলে পদ্ধতিগত গবেষণা দরকার হয়। গুগল করে একটি তথ্য পেলাম আর গবেষণা বলে তা লিখে দিলাম গবেষণালব্ধ দাবি এত সহজ নয়। কিন্তু তিনি কোনো মেথডোলজি বা গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ ছাড়াই একটি সংবাদ সূত্র ব্যবহার করে ইতিহাসকে পাল্টে দিতে যে কসরত করেছেন তা থেকে বোঝা যায় ইতিহাসচর্চা করা তার উদ্দেশ্য নয়, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর পারপাস সার্ভ করতেই তিনি আদাজল খেয়ে নেমেছেন।

তবে তিনি যে সংবাদের বরাদে একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা দুই হাজার বলে দাবি করছেন ওই সূত্রে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে দুই হাজার জন নিহত হয়েছেন এমন কোনো কথা বলা হয়নি। সাংবাদিক উইলিয়ান ড্রামন্ড-এর ওই সংবাদে বলা হয়েছে: "Since the third week of March when the Inspector General's office in the Bangladesh Home Ministry began its field investigations, there have been about 2000 complaints from citizens about deaths at the hands of the Pakistani Army." ওই সংবাদে মূলত দাবি করা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে প্রায় দুই হাজার হত্যার অভিযোগ জমা পড়েছিল।

প্রায় দুই হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে: এই কথাকে দুইভাবে বলা যায়, প্রায় দুই হাজার জনকে হত্যার জন্য প্রায় দুই হাজারটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। অর্থাৎ একজনকে হত্যার জন্য একজন অভিযোগ করেছিল। আবার এর অর্থ এভাবেও করা যায়, প্রায় দুই হাজারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় দুই হাজারটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় যে একটি ঘটনায় যখন একাধিক জন মারা যান তখন একটি ঘটনায় একটি মামলাই হয়। আরো সহজভাবে বললে একটি ঘটনায় হয়তো পাঁচজন মারা গেছেন তবে ওই ঘটনায় পাঁচটি আলাদা মামলা না হয়ে একটি মামলা হয়েছে। এমনও হতে পারে একটি ঘটনায় দশ হাজার জন মারা গেছেন, কিন্তু মামলা হয়েছে একটি।

উপরের সংবাদের প্রায় দুই হাজারটি হত্যার অভিযোগ দিয়ে তাই স্পষ্টভাবে দাবি করার সুযোগ নেই যে প্রায় দুই হাজার জন নিহত হয়েছিল। অন্যদিকে, ওই সংবাদে রাজাকার, আলবদর, আলশামসের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলার বিষয়ে কিছু বলা নেই। তাই ওই ব্লগারের বক্তব্য গ্রহণ করার বিপদ হচ্ছে, এটা মনে হবে, প্রায় দুই হাজার জন পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল, আর বাকি লাখ লাখ মানুষকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস হত্যা করেছে। সেটি আরও বিপজ্জনক ন্যারেটিভ। কারণ তখন মনে হবে, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির সঙ্গে বাঙালির যুদ্ধ হয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ছিল সাজাই। তখন ইতিহাস বিকৃতির নতুন খেলা জমবে।

সংখ্যাতাত্ত্বিক বির্তক তুলে আদৌতে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় বন্ধ করা যাবে না। পাকিস্তান সরকারের উচিত যদি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় তাহলে একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। পাকিস্তান যদি সত্যিকার বাংলাদেশকে ভাই মনে করে তাহলে ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের ক্ষমা চাওয়ায় এত অনীহা কেন? গণহত্যার দায়ে ক্ষমা চাওয়ার বহু নজির বিশ্বে রয়েছে সেই দৃষ্টান্ত থেকেও পাকিস্তান অনুপ্রাণিত হতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত সেই বিষয়ে এবার নজর দেওয়া যাক। এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। বিশ্ব অ্যাকাডেমিয়ার খ্যাতিমান গবেষকরা এই বিষয়ে একমত হননি। অনেকে যেমন ত্রিশ লাখের কম বলে দাবি করেছেন আবার অনেকে ত্রিশ লাখের অধিক হবে বলে দাবি করেছেন। তাদের প্রত্যেকের কথার যুক্তি আছে বলেই অ্যাকাডেমিয়ায় গবেষণা লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকদের মধ্যে শর্মিলা বসু দাবি করেছেন পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ লোক ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মারা গেছে। তার এমন দাবি অ্যাকাডেমিক গবেষণা তাই তা আলোচনা-পর্যালোচনার দাবি রাখে। তবে এক কথায় শর্মিলা বসুর দাবি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি কারণ তার উৎস ব্যবহার পদ্ধতির ত্রুটি রয়েছে। সহজে বললে কেউ যদি সূরা নিসায় এর আয়াত: ৪৩-এর আংশিক পড়ে (“তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না।”) দাবি করেন, আল্লাহ আলকুরআনে নামাজ পড়তে নিষেধ করেছেন, তাহলে তা প্রকৃতপক্ষে ওই আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা হবে। ওই আয়াতে প্রকৃতপক্ষে বলা হয়েছে, “হে, মুমিনরা, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না।”

শর্মিলা বসু অনেকটা আল্লাহ কুরআনে নামাজ পড়তে নিষেধ করেছেন দাবি করা ব্যক্তির মতো ইতিহাসের উৎসের আংশিক তথ্য ব্যবহার করে ইতিহাস লিখেছেন, সেই কারণে আমার কাছে তার লেখা একাত্তরের গণহত্যার ইতিহাস গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার দাবির সমালোচনা করে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছি: “একাত্তরে নারী নির্যাতন সম্পর্কিত শর্মিলা বসুর চিন্তাধারার পুনর্মূল্যায়” যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ প্রকাশিত গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাই এখানে বিস্তারিত কথা বাড়াচ্ছি না। প্রবন্ধটি পড়তে চাইলে ক্লিক করুন

অন্যদিকে প্রতিচিন্তায় প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বাংলাদেশি গবেষক আরিফ রহমান তার “মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ: মিথ না রিয়েলিটি?” প্রবন্ধে দাবি করেছেন: “যেকোনো সোর্স থেকে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাদবাকি প্যারামিটারে সর্বোচ্চ মানগুলো গ্রহণ করলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের চেয়ে অনেক বেশি।” আরিফ রহমানের প্রবন্ধটি তর্ক-বিতর্ক পরিসরে মূল্যায়নের দাবি রাখে আগ্রহীরা প্রবন্ধটি পড়তে চাইলে ক্লিক করুন

যে সব বাঙালি দুই হাজারের পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন তারা পাকিস্তানি উৎস বিশেষ করে হামদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২৬ হাজার সাধারণ মানুষ হত্যার প্রতিবেদন অন্তত দেখতে পারতেন। কিন্তু বাঙালি হয়ে, বাংলাদেশি হয়েও পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের চেয়ে বেশি অস্বীকারকারী হওয়ার প্রবণতা ‘মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি’ হওয়ার মতো হয়ে গেল না!

ত্রিশ লাখের দাবি শেখ মুজিবের নয় ইয়াহিয়ার

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা “তিন লাখ” বলতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান “থ্রি মিলিয়ন” বলেছেন বলে যারা দাবি করেন তারা স্থূল মস্তিষ্কের মানুষ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়া যে নেতা ৭ মার্চের ভাষণের মতো অমরকাব্য সৃষ্টি করেন, যিনি তার সারাজীবন বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি তিন লাখ আর থ্রি মিলিয়ন বক্তব্য দেবার সময় গুলিয়ে ফেলবেন এমন দাবি মুজিব বিরোধীদের তার মেধা ও যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার অন্ধত্ব ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, ত্রিশ লাখ বা তিন মিলিয়নের প্রসঙ্গটি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম আলোচনায় আনেন পাকিস্তানি শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

Anwar Ouassini and Nabil Ouassini তাদের “Kill 3 Million and the Rest Will Eat of Our Hand” : Genocide, Rape, and the Bangladesh War of Liberation” লেখায় দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, “Kill 3 million (Bengalis)... and the rest will eat of our hand.” মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রেও ওই বিষয়টি উল্লেখ আছে। চরমপত্রের ভাষায়: “...২৫ মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করণের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙালির খুন দিয়া গোসল করল।”(চরমপত্র; পৃ: ৩২৫)।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবাদপত্রে যখন বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে সংবাদপ্রচার করা হয় তখন আসলে কোথায় কতজন নিহত হয়েছেন, কে শত্রুপক্ষ আর কে মিত্রপক্ষ তা নিশ্চিত করা অসম্ভব ছিল। কারণ তখনও গণহত্যা নিয়ে কোনো জরিপ প্রকাশিত হয়নি। যুদ্ধক্যাম্প বা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে সবাই ঘরে ফেরেনি। তাই সংখ্যাতাত্ত্বিক জরিপের আলোকে গণহত্যার সত্য সংখ্যা প্রচার করা সম্ভব ছিল না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলার আগেই সাংবাদিকরা ইয়াহিয়ার ওই ত্রিশ লাখ হত্যার আহ্বানকে ধরে একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে ত্রিশ লাখ হত্যার স্বীকার হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছেন। দৈনিক পূর্বদেশ, রাশিয়ার প্রাভদা, মর্নিং নিউজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্রিশ লাখ বলার আগেই থ্রি মিলিয়ন বা ত্রিশ লাখ সংখ্যাটি প্রচার করেছে। এক্ষেত্রে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষে’র মতো দায়টা শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাড়ে না দিয়ে হ্যাডম থাকলে ইয়াহিয়ার ঘাড়ে দাও! কিন্তু দেশের মধ্যে যতোই চোটপাট করুক না কেন ওই ব্লগারসহ পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের ইয়াহিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে কথা বলার সেই হ্যাডম আদৌ আছে কি?

সংখ্যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য:

যারা গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করেন তাদের আসল উদ্দেশ্য জ্ঞান চর্চা নয়, বরং বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে অস্বীকার করা। যদি সত্যিকার অর্থে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি দায় ও দরদ থাকতো তাহলে তারা সংখ্যার বির্তক না করে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে চেষ্টা করতো। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন তৎপরতা আমরা কখনো দেখিনি। এমনকি তারা সুযোগ পেলে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা হয়েছে তা অস্বীকার করতে চায়।

কিন্তু মনে রাখা দরকার, গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় সংখ্যার গুরুত্ব থাকলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হত্যার উদ্দেশ্য কি ছিল সেই বিষয়টি। জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মীয় বা নৃতত্ত্বীয় গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত মানুষকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নির্মূল করতে হত্যাকাণ্ড চালালে তা গণহত্যা হয়। বাংলাদেশে একাত্তর সালে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এই দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যরা ওই কাজটি করেছিল বলেই অ্যাকাডেমিক গবেষণায় বাংলাদেশের গণহত্যা হয়েছে বলে দেশি-বিদেশি স্বীকৃত গবেষকরা লিখছেন, স্বীকার করছেন।

তাই সংখ্যাতাত্ত্বিক বির্তক তুলে আদৌতে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় বন্ধ করা যাবে না। পাকিস্তান সরকারের উচিত যদি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় তাহলে একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। পাকিস্তান যদি সত্যিকার বাংলাদেশকে ভাই মনে করে তাহলে ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের ক্ষমা চাওয়ায় এত অনীহা কেন? গণহত্যার দায়ে ক্ষমা চাওয়ার বহু নজির বিশ্বে রয়েছে সেই দৃষ্টান্ত থেকেও পাকিস্তান অনুপ্রাণিত হতে পারে।

অবশ্যই পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস যারা একাত্তরে শহীদ হয়েছেন তাদের হাতে তাদেরকে বিধর্মী, কাফের, ভারতের দালাল মনে করে নিধন করেছিল। আর তাদের দৃষ্টিতে সাচ্চা মুসলমানের বাচ্চা ছাড়া কেউ নিহত হলে শহীদ হয় না। তাই তারা যদি সেই মনোভাব এখনও পোষণ করে তাহলে এত সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে এত ভণিতা না করে, ইতিউতি বলে ভোজং ভাজাং না করে, এত ত্যানা না পেঁচিয়ে এক লাইনে বলে দিলেই তো হয় আমাদের শরিয়াতের দৃষ্টিতে একাত্তরে শহীদ হয়নি কেউ বাংলাদেশে!

পরিশেষে, জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি ভারত বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে নতুন করে রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। একাত্তরকে সামনে না এনে বিতর্কমূলক কথা না বলে তারা যদি একাত্তর প্রশ্নে চুপও থাকতো তাহলেও তাদের সামনে রাজনীতিতে ভালো করার বিরাট সুযোগ হাতছানি দিচ্ছিল। কিন্তু কি কারণে তারা যেন লেবু বেশি কঁচলালে তিতা হয় কথাটি ভুলে রাজনীতিতে দিনে দিনে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এমএস

Read Entire Article