বর্তমান ইউরোপে এবং ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। এর পশ্চিমে গ্রিস, পূর্বে লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, উত্তরে তুরস্ক এবং দক্ষিণে মিশর অবস্থিত। মুসলমানদের স্বর্ণযুগেই সাইপ্রাস বিজিত হয়। এ সম্পর্কে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী ছিল—‘আমার উম্মতের প্রথম সেনাবাহিনী যারা সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণ করবে, তারা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নেবে।’ (বোখারি, হাদিস: ২৯২৪)। সমুদ্র অভিযান বিষয়ে সিরিয়ার গভর্নর হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে সমুদ্র অভিযানের অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। কিন্তু ওমর (রা.) তাতে সম্মত ছিলেন না। একবার চিঠিতে মুয়াবিয়া (রা.) সাইপ্রাস অভিযান সম্পর্কে গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সিরিয়ার হোমসের একটি গ্রাম থেকে সাইপ্রাসের কুকুরের হাঁক আর মোরগের ডাক শোনা যায়। এতে ওমর (রা.) প্রভাবিত হয়ে যান।’ (তারিখে তাবারি: ৪/২৫৭)। তিনি মিশরের গভর্নর আমর ইবনুল আস (রা.)-এর কাছে সমুদ্র অভিযান বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চেয়ে চিঠি লেখেন। তার বিবরণের ভিত্তিতে ওমর (রা.) মুসলিম সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার আশঙ্কায় অনুমতি না দিয়ে মুয়াবিয়া (রা.)-কে কড়াভাবে নিষেধ করে দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! রোম সাগরের বিশাল তিমির চেয়ে একজন মুসলিমের জীবন আমার কাছে অধিক প্রিয়। সুতরাং আমাকে বিরক্ত করবেন না।’ (আল-কামিল ফিত তারিখ: ২/৪৬৯)। হজরত ওমরের শাহাদাতের পর তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা.)-এর জামানায় মুয়াবিয়া (রা.) বারবার অভিযানের অনুমতি প্রার্থনা করতে থাকায় পরিশেষে তিনি আবেদন গ্রহণ করেন এবং শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি প্রদান করেন।
হিজরি ২৭-২৮ সালে মুয়াবিয়া (রা.) নৌবাহিনী গঠন করে তৎকালীন ‘কুবরুস’ দ্বীপ তথা বর্তমান সাইপ্রাসে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে অংশগ্রহণ করেন হজরত আবু দারদা, আবু জর গিফারি, উবাদাহ বিন সামিত এবং তার স্ত্রী উম্মে হারাম বিনতে মিলহান, মিকদাদ এবং শাদ্দাদ বিন আউস (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিরা। এ যুদ্ধে একমাত্র নারী সাহাবি উম্মে হারাম শাহাদাতবরণ করেন। তার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটাও নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী ছিল। এ সম্পর্কে উম্মে হারাম নিজেই বলেন, ‘একদা আল্লাহর নবীজি আমার ঘরে ঘুমিয়েছিলেন (তিনি নবীজির মাহরাম ছিলেন)। অতঃপর জেগে উঠে মুচকি হাসতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি হাসলেন কেন? তিনি বললেন, আমার উম্মতের এমন কিছু লোককে আমার সামনে উপস্থিত করা হলো যারা এই নীল সমুদ্রে আরোহণ করছে, যেমন বাদশাহ সিংহাসনে আরোহণ করে। উম্মে হারাম বললেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তার জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয়বার ঘুমিয়ে গেলেন এবং আগের মতোই করলেন। উম্মে হারাম আগের মতোই বললেন এবং নবীজিও আগের মতোই জবাব দিলেন। উম্মে হারাম বললেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন তিনি যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। নবীজি বললেন, তুমি প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’ এই প্রথম দলটিই মুয়াবিয়া (রা.)-এর সাইপ্রাস বিজয়ী নৌবাহিনী ছিল। যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফেরার পথে উম্মে হারাম ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে ঘাড় মটকে শাহাদাতবরণ করেন। (বোখারি, হাদিস: ২৭৯৯)। তাকে সেখানেই দাফন করা হয়। তার কবরটি ‘পুণ্যাত্মা নারীর কবর’ হিসেবে সাইপ্রাসে প্রসিদ্ধ। (আল-কামিল ফিত তারিখ: ২/৪৭০)। ১৮ শতকে উসমানি সুলতান এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে ‘হালা সুলতান টেক্কে’ নামকরণ করে।
সাইপ্রাস তখন বাইজেন্টাইন রোমকদের অধীন ছিল। তারা সাইপ্রাসকে তাদের সেনাঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করত। মুয়াবিয়া (রা.) আক্রমণ করলে দ্বীপবাসী বাইজেন্টাইনদের সাহায্য না পেয়ে মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি করে। ফলে ইসলামী সাম্রাজ্য সর্বপ্রথম ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে। এর আগে রোমান শাসকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধ ও চুক্তির ধারাবাহিকতায় একবার রোমান শাসক চুক্তি ভঙ্গ করে সাইপ্রাসে আশ্রয় নেয়। সাইপ্রাসবাসীও মুসলমানদের সঙ্গে কিছু চুক্তি ভঙ্গ করে। এতে মুয়াবিয়া (রা.) রাগান্বিত হয়ে ৩৩ বা ৩৫ হিজরিতে ৫০০ যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে সাইপ্রাস আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে সেনাধ্যক্ষ হিসেবে নেতৃত্ব দেন আবদুল্লাহ বিন কায়স আল-জাসি (রা.)। অন্যদিকে মিশরের তৎকালীন গভর্নর আবদুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ (রা.) মিশর থেকে আরেকটি সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হন। উভয়ের আক্রমণে পরাজিত দ্বীপবাসী বাইজেন্টাইনদের সাহায্য না পেয়ে বার্ষিক সাত হাজার দিনার কর মুসলমানদের এবং রোমানদের দেওয়ার বিনিময়ে সন্ধি চুক্তি করে। মুয়াবিয়া (রা.) দ্বীপের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সেখানে ১২ হাজার সৈন্য রেখে আসেন। সেখানে একটি নতুন শহর গড়ে ওঠে এবং একটি মসজিদও নির্মাণ করা হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপীয়রা নৌশক্তি অর্জন করলে মুসলমানরা ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ হারায়। ধীরে ধীরে সাইপ্রাসসহ ভূমধ্যসাগর খ্রিষ্টানদের দখলে চলে যায়। সাইপ্রাসের খ্রিষ্টানরা ভূমধ্যসাগরে হজযাত্রী ও বণিকদের জাহাজ লুণ্ঠন করতে থাকায় সুলতান সেলিমের নির্দেশে লালা মোস্তফা পাশা ১৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে সাইপ্রাস দখল করেন। ফলে সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। উসমান খলিফারা ৩০০ বছর সাইপ্রাস শাসন করেন।
১৮৭৭-৭৮ সালে সুলতান আবদুল হামিদের শাসনকালে রাশিয়া-তুর্ক যুদ্ধে উসমানিরা হেরে যাওয়ায় বার্লিন চুক্তির ভিত্তিতে দ্বীপটি ১৮৮২ সালে ব্রিটেন দখল করে নেয়। ১৯৬০ সালে ব্রিটিশরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় গ্রিস ও তুরস্ক ভবিষ্যতে সামরিক উদ্যোগ নিতে পারবে এমন এক বিধান রেখে সাইপ্রাসকে স্বাধীনতা প্রদান করে। এ সুযোগে ১৯৭৪ সালে গ্রিক সেনাবাহিনী সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সাইপ্রাসের দক্ষিণাংশ দখল করে এবং তুরস্কও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে উত্তরাঞ্চলের ৩৫ শতাংশ দখল করে নেয়। পরবর্তীকালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বাফার জোনের মাধ্যমে সাইপ্রাসকে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে সাইপ্রাসের তুরস্ক অধিকৃত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে টার্কিশ এবং গ্রিক অধিকৃত খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬৫ শতাংশকেই মূলত সাইপ্রাস বলা হয়। এভাবেই সাইপ্রাসে মুসলমানদের উত্থান ও পতন ঘটে।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক