মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি রাখতে হবে

1 week ago 10

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি এখন ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে এখনই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ধরে রাখতে হবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এম মাসরুর রিয়াজ

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অর্থনীতির চলমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. সামিউর রহমান সাজ্জাদ

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বিশ্বব্যাংক দেশের অর্থনীতির জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, বহিস্থ খাতের চাপ, আর্থিক খাতের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?

মাসরুর রিয়াজ: মূল্যস্ফীতি, বহিস্থ খাতের চাপ, আর্থিক খাতের দুর্বলতা আমাদের অর্থনীতিতে আড়াই বছর ধরে বিরাজমান, যা এখনো চলমান। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন কিছুটা ঠেকানো গেছে, এটা একটা ভালো দিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব ৫ আগস্টের পর কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে রিজার্ভের পতন রোধে এবং স্থিতিশীল রাখতে প্রাথমিক সাফল্য এসেছে। তবে এটা ধরে রাখতে হবে।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির যে সিদ্ধান্তগুলো অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতারা এসব সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করেছে। ততদিনে মূল্যস্ফীতি একটা লেভেলে চলে গেছে।

বিপুল জনসংখ্যার আমাদের এত বড় অর্থনীতিতে মাত্র ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যথেষ্ট নয়। করোনা মহামারির আগেও আমাদের রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। মূল্যস্ফীতি একটু কমেছিল, এখন আবার বেড়েছে। অর্থনৈতিক চাপের আগে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ ছিল। আমাদের সেখানে যেতে হবে।

আগস্টের ৫ তারিখের পর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের পছন্দের অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। তবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা আছে। যেমন- প্রশাসনে এখনো বদলি, নতুন নিয়োগ হচ্ছে, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। শিল্প বেল্টে শ্রমিক অসন্তোষ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। দিন শেষে জনগণের আকাঙ্ক্ষা তাদের দেওয়া ভোটের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকার আসবে। সেটা কবে আসবে, কীভাবে হবে সেই ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কার নয়, এটাও অনিশ্চয়তা। এগুলোও দূর করতে হবে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৯ দশমিক ৫ পয়েন্ট থেকে বাড়িয়ে ১০ পয়েন্টে উন্নীত করেছে। এটি কতটুকু সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন?

মাসরুর রিয়াজ: এটা একটা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই যে ব্যবসায়িক খরচ বাড়বে, কারণ ঋণের খরচ বাড়বে। তবে এটি না করে উপায় নেই, কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি এখন ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া আগামী বছর মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে অনুমান করেছে আইএমএফ। ফলে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কারণ মূল্যস্ফীতি বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যমান প্রভাবিত করে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একটা পন্থা হচ্ছে নীতি সুদহার বাড়ানো।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির যে সিদ্ধান্তগুলো অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতারা এসব সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করেছেন। ততদিনে মূল্যস্ফীতি একটা লেভেলে চলে গেছে। আমরা আশা করছি নীতি সুদহার বেশিদিন বাড়িয়ে রাখতে হবে না।

মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি রাখতে হবে

তবে এখনই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। নীতি সুদহার যতটুকু বাড়ানো হয়েছে ততটুকু না বাড়ালে হয়তো মূল্যস্ফীতি আরও বেশি থাকতো। মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাদের আরও কিছুদিন এই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ধরে রাখতে হবে। তবে আমরা আশা করবো এর সঙ্গে আরও অন্যান্য সম্পূরক পদক্ষেপ আছে। যেমন- মার্কিন ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যেন আমদানি খরচ কমে; আমদানি নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে সহজ করা যেন সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক থাকে; সাপ্লাই চেইন সিস্টেম মনিটরিং ইত্যাদি নিতে হবে। নয়তো শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমবে না।

জাগো নিউজ: গত দুই মাসে রিজার্ভের পতন কিছুটা কমেছে, ফলে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। এটা বজায় রাখতে কী কী পদক্ষেপ জরুরি?

মাসরুর রিয়াজ: প্রথমত, স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের রিজার্ভ আরও শক্তিশালী করতে হবে অর্থাৎ মার্কিন ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স তো রাতারাতি বাড়বে না। এজন্য আমাদের উন্নয়ন অংশীদার যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে বাজেট সহায়তা লোন নিতে হবে।

আমরা দেখেছি তাদের কাছে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে, কেউ কেউ আগের চেয়ে অতিরিক্ত দিয়েছে। আমি মনে করি, ছয় মাসের মধ্যে যদি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করতে পারি তাহলে গত দুই মাসে রিজার্ভের যে পতন রোধ করা গেছে তা টেকসই করা যাবে।

দু-একটা ব্যাংক হয়তো কোনোভাবেই দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। সেগুলোর ব্যাপারে এখনই কোনো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ বা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু করতে হবে, কারণ এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।

এরই মধ্যে আইএমএফ থেকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আশ্বাস পাওয়া গেছে। এটাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং আরও ৩-৪ বিলিয়ন ডলার আনার চেষ্টা করতে হবে। সেই আলোচনা সৌদি আরবের সঙ্গে হতে পারে, জাপানের সঙ্গে হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স যেন কোনোভাবেই কমে না যায়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে, নয়তো চৌবাচ্চার একটা ফুটা বন্ধ করতে গিয়ে নতুন দুটা ফুটা সৃষ্টি হবে। তাই রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য যে ধরনের নীতিসহায়তা, আস্থা নির্মাণের ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাসহ যা যা লাগবে সবকিছু দিয়ে যেতে হবে।

জাগো নিউজ: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। কিন্তু আইএমএফ গত ২২ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করেছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মাসরুর রিয়াজ: আমার মনে হয় আমাদের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে যেটা প্রাক্কলন করা হয়েছিল সেটা বাস্তবতার সঙ্গে বিপরীতধর্মী। কারণ, বাজেটটি হয়েছিল পূর্ববর্তী সরকারের সময়। তারা অর্থনৈতিক তথ্য, লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নানা ধরনের ম্যানিপুলেশন করেছে। জোর করে অনেক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এমনটা দেখানোর প্রচেষ্টা ছিল তথ্য হেরফের করে।

এক ধরনের রাজনৈতিক সমাধান হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখনো অনিশ্চয়তা আছে। ফলে আমাদের বিনিয়োগ থেমে আছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ এবং দেশি বিনিয়োগের বড় একটি অংশ ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মুডে চলে গেছে।

আমাদের রপ্তানি জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত ঋণাত্মক ধারায় ছিল। মাত্র দু-তিন মাস ধরে এটি অল্প পজিটিভ ধারায় ফিরেছে। একই সময়ে আমাদের আমদানি বাধা আছে। ফলে কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতির সরবরাহ সীমিত হয়েছে। এ কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার বন্যা হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই আইএমএফের প্রাক্কলনই বাস্তব এবং অর্জনযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। আর মূল্যস্ফীতি তো প্রমাণিত।

জাগো নিউজ: নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব ঘাটতি ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। রাজস্ব বৃদ্ধিতে করণীয় কী?

মাসরুর রিয়াজ: রাজস্ব ঘাটতি দুর্বলতা হঠাৎ কোনো বিষয় নয়, এটা বহু বছরের। এই দুর্বলতার ধারাবাহিকতায়ই আমরা প্রতি বছরই অবলোকন করি। অর্থনৈতিক তথ্য ম্যানিপুলেশনের একটা অংশ আমরা দেখেছি যে রাজস্ব সংগ্রহকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে, যা আগে থেকেই সন্দেহ করা হচ্ছিল, এখন মোটামুটি প্রমাণিত। ফলে যেসব বছরের উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছিল সেখানেও খুঁজলে দেখা যাবে ঘাটতি ছিল।

আমাদের রাজস্ব খাতের মূল দুর্বলতা হচ্ছে রাজস্ব আইন। যদিও নতুন দুটি আইন গত বছর এসেছে। তবে সেগুলো কতটা বাস্তবধর্মী, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সহায়ক, করদাতাদের জন্য সহায়ক সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। ফলে নতুন আইনগুলো আবার পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজন।

এটা একটা ভালো দিক যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়কর আইন, ২০২৩ পুনর্মূল্যায়ন করবে বলেছে। কাস্টমস আইন, ২০২৩ এবং আয়কর আইন কতটা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং করদাতাদের জন্য সহায়ক সেটা ভেবে দেখার বিষয় আছে।

আর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে ২০১২ সালের খুব সুন্দর আইনটি খোঁড়া করে দেওয়া হয়েছে। তাই আইনটি খুব ভালোভাবে আধুনিকীকরণ করতে হবে।

কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা রয়েই গেছে। কর বিভাগের ঐচ্ছিক ক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে করদাতা যা পরিস্থিতি তুলে ধরেন আর কর অফিসার যা পরিমাপ করেন তার মধ্যে অনেক পার্থক্য থেকে যায়। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা অনেক বিভ্রান্তি এবং ভোগান্তিতে পড়েন। কীভাবে এই ভোগান্তি, অভিযোগ কমানো যেতে পারে এবং ঐচ্ছিক ক্ষমতায় স্বচ্ছতা আনায়ন অনেক জরুরি হয়ে পড়েছে।

পরিশেষে, ডিজিটালাইজেশন কিছু হয়েছে, সব নয়। যেমন ভ্যাট, আয়কর ইত্যাদিতে হয়েছে, কিন্তু কাজে দিচ্ছে না। কাস্টমসে কিছু ভালো পরিকল্পনা আছে যেমন- ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডাব্লিউ), যা বাস্তবায়ন করতে হবে। সার্বিকভাবে কর নেওয়ার যে কৌশল সেটি দেশের অর্থনৈতিক কৌশল, বিনিয়োগ কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

রাতারাতি কর বেড়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। রাজস্ব আহরণ বহুদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। তবে এখনই সময় এটি সংস্কার করার। সরকার ভালো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, রাজস্ব খাত সংস্কারে কমিটি করা হয়েছে। আমরা মনে করি এনবিআরের নতুন নেতৃত্ব অনেক বেশি সংস্কারমনা। তবে সমন্বিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

জাগো নিউজ: অর্থনীতির বহু আলোচিত সমস্যা পরিসংখ্যানের হিসাবের গরমিল। এটি সমাধানের উপায় কী?

মাসরুর রিয়াজ: প্রথমত, যেখানে গরমিল বা হেরফের হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে। এরপর সমাধান করে সঠিক উপাত্ত প্রকাশ করতে হবে। আমাদের ভিত্তিতেই সমস্যা, তাহলে আমরা তুলনা কীভাবে করবো? তাই আগের হিসাবও ঠিক করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এটা কেন হয়েছে সেটা খুঁজে বেড় করতে হবে যদিও আমরা জানি যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এজন্য দায়ী। কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুঁজে বের করে সেটির যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এবং যারা এজন্য দায়ী তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা রয়েই গেছে। কর বিভাগের ঐচ্ছিক ক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে করদাতা যা পরিস্থিতি তুলে ধরেন আর কর অফিসার যা পরিমাপ করেন তার মধ্যে অনেক পার্থক্য থেকে যায়। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা অনেক বিভ্রান্তি এবং ভোগান্তিতে পড়েন।

তৃতীয়ত, পরিসংখ্যান সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রাখা দরকার। জাতীয় পরিসংখ্যান যেমন- জিডিপি, রপ্তানি, কমসংস্থান, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি প্রকাশের আগে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রাখা উচিত। সেটা বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, উন্নয়ন অংশীদারদের নিয়ে একটা প্যানেল হতে পারে। ফলে সরকারি তথ্য কারও ফোনে পরিবর্তন হবে না।

জাগো নিউজ: শেয়ারবাজারে মূলধনী মুনাফার কর কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর প্রভাব কী?

মাসরুর রিয়াজ: শেয়ারবাজারকে শেয়ারবাজার হিসেবে না দেখে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে দেখতে হবে। সেই অনুযায়ী আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ খুবই সীমাবদ্ধ, প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু এটা ছাড়া আমরা আগামীদিনের প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে পারবো না।

দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন দাঁড় করাতে গেলে সেটার একটা অংশ হচ্ছে শেয়ারবাজার। এটাকে একটা শক্তিশালী ধারায় আনতে হবে, আরও বেশি কোম্পানি যাতে লিস্টেট হয়, বিনিয়োগ বাড়তে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিতে হবে। সেই জায়গায় মূলধনি মুনাফার কর কমানোর বিষয়টি আমি মনে করি লিস্টেট কোম্পানি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে কাজে লাগবে।

জাগো নিউজ: মানুষ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে ফেলছে। ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে করণীয় কী?

মাসরুর রিয়াজ: ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত আমানত তুলে ফেলার হিড়িক ছিল। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তো আমানত তুলতেই পারছে না। আবার ভালো ব্যাংকগুলোতে কিন্তু আমানত ফেরত আসছে।

মূলত ১০-১১টি দুর্বল ব্যাংকে তাদের আগের মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পেয়ে বা সমর্থন নিয়ে লুট করেছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে পাচার করেছে। ফলে এসব ব্যাংকের ৭০-৮০ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। লোন ফেরত না এলে ব্যাংকের আয় হচ্ছে না, আবার আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। ফলে সেসব ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা টাকা তুলতে পারছে না।

মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি রাখতে হবে

বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। তবে এটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য হওয়া উচিত। এটা ১-২ বারের বেশি দেওয়া উচিত নয়। কারণ এই তারল্য সহায়তা দিয়ে খারাপ ব্যাংক বাঁচানো সম্ভব নয়।

একদিকে ফৌজদারি মামলা, তদন্ত করতে হবে। তবে এই ব্যাংকগুলোকে পুনরায় দাঁড় করাতে হলে প্রথমে অলিগার্কদের থেকে মুক্ত করতে হবে, যা করা হচ্ছে। এরপর এই ব্যাংকগুলো দাঁড়াতে পারবে কি না তার একটা মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সহায়তা দিয়ে একটা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করতে হবে। কতটুকু সময়ের মধ্যে কী কী কাজ করে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে, নিজেদের কার্যক্রম চালাতে পারবে, আয় টেকসই করতে পারবে- সেই পরিকল্পনা করতে হবে। এই পরিকল্পনার একটা সময়সীমা থাকবে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ মনিটরিং থাকবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে যে সমর্থন দেওয়া উচিত সেগুলো দিয়ে যাবে।

তবে দু-একটা ব্যাংক হয়তো কোনোভাবেই দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। সেগুলোর ব্যাপারে এখনই কোনো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ বা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু করতে হবে, কারণ এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। সেখানে হয়তো বন্ড ছেড়ে বা শেয়ারবাজারে লিস্টেট হয়ে নতুন টাকা ওঠানোর ব্যবস্থা থাকবে যেন ব্যাংকগুলো পুনরায় তারল্য পায়, যা তাদের পরিকল্পনায় থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো গ্যারান্টি বা রিস্ক শেয়ারিং সুবিধা দিতে পারে।

জাগো নিউজ: দেশে প্রথমবারের মতো ক্রস বর্ডার (আন্তঃসীমান্ত) ডিজিটাল বাণিজ্য নীতিমালা হচ্ছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

মাসরুর রিয়াজ: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, যা আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। ডিজিটাল ইকোনমি সেক্টরকে গ্রো (সম্প্রসারণ) করার ক্ষেত্রে আমরা অনেক লিক সার্ভিস দেখেছি, কিন্তু সত্যিকারের কাজ দেখিনি। এটা এতদিন হয়নি।

এখনকার পৃথিবীটাই চলছে ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে। ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশে এটি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। আগামী দুই দশকে অর্থনীতিতে অন্য যে কোনো মাধ্যমের চেয়ে ডিজিটাল মাধ্যমের অবদান অনেক বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি অবশ্যই ডিজিটাল বাণিজ্যে যেতে হবে, নয়তো আমরা ১৮ কোটি মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারবো না। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে আগামী দিনে ডিজিটাল বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি ডিজিটাল রপ্তানি করতে না পারি তাহলে রপ্তানি বহুমুখী করার সুযোগ হারাবো।

আমাদের ডিজিটাল সেবা রপ্তানি বাড়াতে হবে। এজন্য আমদানিও বাড়াতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি যেমন- বিভিন্ন সফটওয়্যার, ক্লাউড সার্ভিস, ইত্যাদি আমদানি বাড়বে। ফলে আগামী দিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের এই নীতিমালা প্রয়োজন।

জাগো নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকার এসব সমস্যা সমাধানে কী কী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে পারে?

মাসরুর রিয়াজ: নানা কারণে এখন ব্যবসায়ী, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং আস্থার অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে নজর দিয়ে আস্থা ফেরাতে হবে, অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণভাবে দূর করতে হবে।

ব্যাংকখাতে কিছু ভালো উদ্যোগ এসেছে। একই উদ্যোগ রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে দিতে হবে। বিনিয়োগ, বাণিজ্যের সক্ষমতা সংক্রান্ত সংস্কার দ্রুত শুরু করা উচিত। কারণ তিন মাস অনেক সময়। কারণ এগুলোর বেশিরভাগই আমাদের জানা যে কী করতে হবে।

তাই আমার মনে হয়, একটি সংস্কার পরিকল্পনা দ্রুত প্রকাশ করা উচিত এবং তার বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত।

এসআরএস/ইএ/এমএমএআর/এএসএম

Read Entire Article