মৃত্যুর আগে যে চারটি শব্দ বলেছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ

7 hours ago 3

এস ইসলাম, লন্ডন থেকে

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের তৃতীয় মুত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে ৮ সেপ্টেম্বর। ব্রিটেনসহ পুরো বিশ্ববাসী এ দিনে স্মরণ করেছে ব্রিটেনের সবচেয়ে লম্বাসময় ধরে শাসন কার্য পরিচালনাকারী এ সম্রাজ্ঞীকে। তাকে স্মরণ করতে সুদূর আমেরিকা হতে ছুটে এসেছে প্রিন্স হ্যারীও। ঘনিষ্ঠভাবে রানীর সান্নিধ্যে আসা কেউ কেউ করেছেন স্মৃতি রোমন্থন। এসব নিয়েই আজকের আলোচনা।

১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল জন্ম নেওয়া ছোট্ট এলিজাবেথকে সবাই চিনতেন শান্ত স্বভাবের এক কিশোরী হিসেবে। কেউ ভাবেনি তিনি একদিন হয়ে উঠবেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসনকর্ত্রী। ভাগ্যের মোড় ঘুরল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কিশোরী বয়সেই তিনি সেনাদের সহায়তায় গাড়ি চালানো ও যন্ত্রপাতি মেরামতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন—যা প্রমাণ করেছিল তার ভেতরে দায়িত্ববোধ কতটা গভীর।

১৯৫২ সালে, মাত্র ২৫ বছর বয়সে, হঠাৎ করেই বাবার মৃত্যুতে তিনি সিংহাসনে বসেন। সেই থেকে শুরু হলো এক মহাকাব্যিক যাত্রা। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছেন বৈশ্বিক পরিবর্তনের ঝড়ের মাঝেও।

তার শাসনামলে ব্রিটেন ঔপনিবেশিক যুগ থেকে বেরিয়ে আসে, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তিনি ছিলেন কমনওয়েলথের মুখ, যিনি ভিন্ন সংস্কৃতির দেশগুলোকে একতার বন্ধনে ধরে রেখেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনেও এলিজাবেথ ছিলেন অসাধারণ। প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে তার ৭৩ বছরের দাম্পত্য ছিল প্রেম আর সহযাত্রার গল্প। কিন্তু স্বামী হারানোর পরও তিনি থামেননি। সর্বদা জনগণের সেবাকে নিজের অনুভূতির চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন।

তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল সংযম ও স্থিরতা। রাজপরিবার নানা বিতর্কে জড়ালেও তিনি ছিলেন ‌‘দৃঢ়তার প্রতীক’—যেন এক নীরব আশ্বাস যেসব ঠিক হয়ে যাবে।

তার পুরো শাসনামলে রানী এলিজাবেথ তার অটল দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও রাজকীয় দায়িত্ব পালন করার জন্য পরিচিত ছিলেন। নিজের অনুভূতির চেয়ে দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতাই তাকে ব্রিটিশ জনগণের কাছে এতটা সম্মান এনে দিয়েছিলেন।

রানীর মৃত্যুর তিন বছর পর রাজ পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে ব্রিটেনের দ্য মিরর পত্রিকা জানায় যে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ জীবনের একেবারে শেষ সময় পর্যন্তও দৃঢ় স্থির মনোভাব থেকে বিচ্যুত হননি।

জানা যায়, যখন চিকিৎসকেরা তাকে জানান তিনি মাল্টিপল মাইলোমা নামক এক ধরনের অস্থিমজ্জার ক্যানসারে আক্রান্ত এবং তার হাতে সময় খুব বেশি বাকি নেই, তখনও তিনি তার স্বভাবসুলভ ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানান।

এই রোগ নির্ণয়টি হয় ২০২১ সালে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি তার ৭৩ বছরের সঙ্গী প্রিন্স ফিলিপকে হারানোর পর। এত গভীর শোকের মাঝেও তিনি অসীম সাহস দেখিয়েছিলেন এবং তার চিকিৎসকদের কাছে একটি আবেগময় অনুরোধ করেছিলেন।

জানা যায়, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন জেনে রানীর সাহসী চার শব্দের প্রতিক্রিয়া ছিল—

‘আচ্ছা, এটা তো দুঃখজনক।’

উইন্ডসর পরিবারের প্রাক্তন বাটলার পল বারেল দাবি করেন, চিকিৎসকেরা প্রথমে মনে করেছিলেন রানী হয়তো ২০২১ সালের বড়দিন পার করতে পারবেন না। কিন্তু ৯৫ বছর বয়সে দুঃসংবাদ শোনার পরও তিনি সংযতভাবে এই চারটি সহজ শব্দ উচ্চারণ করেন। যদিও বাইরে থেকে সংযমী দেখালেও, তিনি ভেতরে ভেতরে বিস্মিত হয়েছিলেন যে মৃত্যু এত কাছে চলে এসেছে।

বারেলের দাবি অনুযায়ী, রানী আরও বলেন এটা আসলেই দুঃখজনক, কারণ পরের বছর তার প্লাটিনাম জুবিলি এবং তিনি তা দেখতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি চিকিৎসকদের অনুরোধ করেন, ‘আপনারা কি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন অন্তত সেই সময় পর্যন্ত?’

বারেল বলেন, তিনি নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করিয়েছেন এবং চিকিৎসকদের নির্দেশ কঠোরভাবে মেনে চলেছেন। এমনকি তিনি তার প্রিয় জিন অ্যান্ড টনিক, জিন অ্যান্ড ডুবনেট এবং মার্টিনি পান করা ছেড়ে দিয়ে কেবল আপেল জুস আর রোববারে বিশেষ ট্রিট হিসেবে টমেটো জুস খেতেন—শুধু জীবন কিছুটা দীর্ঘায়িত করার জন্য।

তিনি আরও যোগ করেন, চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন যেন তিনি তার রাজত্বের এই ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্থাৎ প্লাটিনাম জুবিলি দেখতে পারেন। তবে তিনি সব সময় জানতেন যে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

মৃত্যুর আগে রানী তার অসুস্থতার বিষয়টি গোপন রাখার শপথ করিয়েছিলেন আশপাশের মানুষকে। অবশেষে তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ৯৬ বছর বয়সে, চিকিৎসকদের প্রাথমিক ধারণার কয়েক মাস পর মৃত্যুবরণ করেন।

জীবনের শেষ কয়েক সপ্তাহ তিনি কাটিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের বালমোরালে, যেখানে রাজপ্রাসাদের অনেক কর্মচারীও বুঝতে পারেননি তিনি কতটা অসুস্থ ছিলেন।

অবশেষে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, স্কটল্যান্ডের বালমোরালে, ৯৬ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানান।

রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় শুধু একজন রানি ছিলেন না—তিনি ছিলেন দায়িত্ব, স্থিতিশীলতা এবং একতার জীবন্ত প্রতীক। তার জীবন প্রমাণ করে, সত্যিকারের নেতৃত্ব মানে নিজের জন্য নয়, মানুষের জন্য বেঁচে থাকা।

রানীর মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিলেন তার পুত্রবধূ সারাহ ফারগুসন। ফারগুসন রানীকে ‘মামা’ বলে ডাকতেন। দ্য সানডে টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফার্গুসন রানীর শেষ কথাগুলো শেয়ার করেছিলেন। মৃত্যুর আগে রানী এলিজাবেথ তার পুত্রবধূকে বলেছিলেন, ‘সারা, মনে রেখো তুমি নিজেই যথেষ্ট ভালো।’

এমআরএম/জেআইএম

Read Entire Article