মৃত্যুর পর মানুষের রুহ অন্য জগতে অবস্থান করে। পবিত্র কোরআনের বিশেষ পরিভাষায় সে জগতের নাম ইল্লিয়্যিন ও সিজ্জিন। ইল্লিয়্যিন হলো জান্নাতের উচ্চতম স্থান, যা মহান রবের আরশের কাছাকাছি। যেখানে মুমিন বান্দাদের আত্মার আবাস হয়। কোনো ব্যাখ্যায় ইল্লিয়্যিন মানে হলো মহান আল্লাহর মুমিন বান্দাদের আমলনামা সংরক্ষণের জায়গা। সেখানে মহান আল্লাহর বিশেষ ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন। যখন মুমিনের আমলনামা সংরক্ষণ করা হয়, তখন তারা সাক্ষী থাকেন। এর বিপরীতে সিজ্জিন শব্দটি এসেছে সিজনুন থেকে, যার অর্থ কারাগার। এটি হলো ইবলিস ও তার অনুসারী কাফির-মুশরিক ও পাপিষ্ঠ আত্মাদের ভয়ংকর আবাস। ইল্লিয়্যিন ও সিজ্জিন সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। নিম্নে সেগুলোর কয়েকটি তুলে ধরা হলো:
এটি সপ্তম আসমান: আমাশ হিলাল ইবনে ইয়াসাফ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম, যখন ইবনে আব্বাস (রা.) কাবকে প্রশ্ন করলেন, সিজ্জিন কী? কাব বলেন, এটি সপ্তম পৃথিবীতে অবস্থিত, যেখানে কাফিরদের আত্মা থাকে। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে ইল্লিয়্যিন কী? কাব বললেন, এটি সপ্তম আসমান, যেখানে মুমিনদের আত্মা থাকে। (তাফসিরে তাবারি)
এটি জান্নাত বা সিদরাতুল মুনতাহা: ইবনুল আজলাহ দ্বহহাক (রহ.) বলেন, ইল্লিয়্যিন হলো সিদরাতুল মুনতাহা, যেখানে আল্লাহর সব আদেশ এসে শেষ হয়; এর বাইরে কিছুই অতিক্রম করে না। (ফাতহুল কাদির: ১/১৫৯৮)।
যে উচ্চতার শেষ নেই: ফাররা (রহ.) বলেন, ইল্লিয়্যিন মানে এমন উচ্চতা, যার পর উচ্চতার শেষ নেই। (ফাতহুল কাদির: ১/১৫৯৮)
এটি ফেরেশতাদের অবস্থানস্থল: বাঘভি (রহ.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই সৎকর্মশীলদের আমলনামা থাকবে ইল্লিয়্যিনে।’ এবং সেটিই ফেরেশতাদের অবস্থানস্থল। এর বিপরীতে ‘নিশ্চয়ই পাপীদের আমলনামা সিজ্জিনে।’ এবং সেটি হলো ইবলিস ও তার বাহিনীর অবস্থানস্থল।
মৃত্যুর পর বান্দার পরকালের সফর কেমন হবে—এবিষয়ক হাদিসগুলোতেও ইল্লিয়্যিন ও সিজ্জিনের বর্ণনা পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো ইমানদার বান্দা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আখেরাতের দিকে যাত্রা করে, তখন আকাশ থেকে তার কাছে ফেরেশতা আসেন। তাদের চেহারা থাকবে সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তাদের সঙ্গে থাকবে জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি। তারা তার চোখ বন্ধ করা পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকবেন। মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তার মাথার কাছে বসবেন। তিনি বলবেন, হে সুন্দর আত্মা! তুমি আল্লাহতায়ালার ক্ষমা ও তার সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। আত্মা বেরিয়ে আসবে, যেমন বেরিয়ে আসে পানপাত্র থেকে পানির ফোঁটা। সেই আত্মাকে গ্রহণ করে একমুহূর্তের জন্যও ছাড়বেন না। অতঃপর তাকে জান্নাতের কাফন পরাবেন এবং সুগন্ধি লাগাবেন। পৃথিবীতে যে মিশক আছে, তা তার চেয়ে বেশি সুগন্ধি ছড়াবে। পরে তাকে নিয়ে তারা (ফেরেশতারা) আসমানের দিকে যেতে থাকবেন। আর ফেরেশতাদের প্রতিটি দল বলবে, কে এই পবিত্র আত্মা? তাদের প্রশ্নের জবাবে তারা তার সুন্দর নাম নিয়ে বলবেন যে অমুকের ছেলে অমুক।
এভাবে প্রথম আসমানে চলে যাবে। তার জন্য প্রথম আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। এভাবে প্রতিটি আসমান অতিক্রম করে যখন সপ্তম আসমানে যাবে, তখন মহান আল্লাহ বলবেন, ‘আমার বান্দার আমলনামাটা ইল্লিয়্যিনে লিখে দাও।... আর যখন কোনো কাফির দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখেরাতে যাত্রা করে, তখন তার কাছে কালো চেহারার ফেরেশতা আগমন করেন। তার সঙ্গে থাকে চুল দ্বারা তৈরি কষ্টদায়ক কাপড়। তারা চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকেন। এরপর আসেন মৃত্যুর ফেরেশতা। তার মাথার কাছে বসে বলেন, হে পাপিষ্ঠ আত্মা! বের হয়ে আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের দিকে চলো। তখন তার দেহে প্রচণ্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেমন—আর্দ্র রেশমের ভেতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়। যখন আত্মা বের করা হয়, তখন একমুহূর্তের জন্যও ফেরেশতা তাকে ছেড়ে দেন না। সেই কষ্টদায়ক কাপড় দিয়ে তাকে পেঁচিয়ে ধরেন। তার লাশ পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আত্মা নিয়ে যখন ওপরে ওঠেন, তখন ফেরেশতারা বলতে থাকেন কে এই পাপিষ্ঠ আত্মা? তাদের জবাবে তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়—অমুক, অমুকের ছেলে। প্রথম আসমানে গেলে তার জন্য দরজা খোলার অনুরোধ করা হলে দরজা খোলা হয় না। অতঃপর আল্লাহতায়ালা বলবেন, তার আমলনামা সিজ্জিনে লিখে দাও, যা সর্বনিম্ন স্তর। এরপর তার আত্মা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৮৫৩৪ অবলম্বনে)
লেখক: ইমাম ও খতিব