• বিলম্বে চিকিৎসা নেওয়াই মৃত্যুর প্রধান কারণ
• জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ
• ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে
• মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে
• প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা সহজলভ্য করতে হবে
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ শনিবার (২৮ জুন) পর্যন্ত ডেঙ্গুতে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
একই সময়ে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসের (মে) তুলনায় চলতি মাসে (জুন) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৬ গুণ ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই গুণেরও বেশি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ও বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
একাধিক স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আগামী দিনগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তাই রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মশকনিধন কার্যক্রম আরও জোরদার ও ডেঙ্গুতে রক্ষায় ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসের ২৮ দিনেই সর্বোচ্চ ১৮ জন মারা গেছে। গত মে মাসের তুলনায় (মাত্র ৩ জন) চলতি মাসে মৃতের সংখ্যা ৬ গুণের বেশি। শুধু মৃত্যুই নয়, মে মাসের তুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাও আড়াইগুণেরও বেশি। তবে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এখনও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা
এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা মোট ৯ হাজার ৪৮৪ জন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন ও চলতি মাসের ২৮ জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ১৩৯ জন ভর্তি হন। হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর মধ্যে ৫ হাজার ৫৮৩ জন পুরুষ (৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং নারী ৩ হাজার ৯০১ জন (৪১ দশমিক ১ শতাংশ)।
- আরও পড়ুন
চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৪০ ছাড়ালো
মশা মারতে ১৮৮ কোটি টাকা খরচ করবে উত্তর সিটি
মশা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্টের নির্দেশ
‘জ্বর হলেই ভয় লাগে, ডেঙ্গু-করোনার আতঙ্কেই হাসপাতালে আসছি’
একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৪১ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে দশজন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, মে মাসে তিনজন ও ২৮ জুন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত ৪১ জনের মধ্যে পুরুষ ২৩ জন (৫৬ দশমিক ১ শতাংশ) ও নারী ১৮ জন (৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ)।
চলতি বছরে বিভাগ ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুসারে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪ হাজার ৩০৬ জন বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া), চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) ১ হাজার ৪১৪ জন, ঢাকা বিভাগে ৮৯৯ জন (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৭৫৭ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১ হাজার ৩৩০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) ২৮১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) ১২৮ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) ৩১৪ জন, রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) ২৬ জন এবং সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া) ৩০ জন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ১৬ বছর থেকে ৩৫ বছর বয়সী রোগীর সংখ্যাই বেশি। মৃতদের মধ্যে ২১ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি।
১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত বিভাগ ও সিটি করপোরেশন বিবেচনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত ৪১ জনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চ ১৯ জন ও বরিশাল বিভাগে ১১ জন (সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া)।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। এর প্রকোপ রোধ করতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা সহজলভ্য করতে হবে। ডেঙ্গু নমুনা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে লম্বা লাইন দিতে হয় বলে মানুষ জ্বর হলে নমুনা পরীক্ষা করাতে চায় না। নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভোগান্তির কারণে তারা বাড়িতেই চিকিৎসা নেয়। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তিতে বিলম্বের কারণে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
- আরও পড়ুন
পটুয়াখালীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত বৃদ্ধের মৃত্যু
সব পরীক্ষার্থীর মুখে মাস্ক দেখছি, করোনা-ডেঙ্গু নিয়ে ভয় নেই
ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে বরগুনার ৫ ওয়ার্ড
তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র সহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রে ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষা সহজলভ্য করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের সবাই বিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা চিকিৎসা নিতে এসেছেন। ভর্তি হওয়ার দু-একদিনের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তারা।
তিনি বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ২১টি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তাই যে কোনো ব্যক্তি জ্বরে আক্রান্ত হলে বিলম্ব না করে হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণে রোগীকে বাঁচানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
২০১৮-২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন, ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন, ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন, ২০২৪ সালে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন ও ২০২৫ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৪৮৪ জন।
এমইউ/এমএএইচ/জেআইএম