ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসের ২১ তারিখে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যারা বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন। এটি বিশ্বের একমাত্র জাতি হিসেবে দেশকে ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় করে রেখেছে, যারা তাদের ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশের কথা বলছি, যাদের ভাষার জন্য শহীদ হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, আমাদের সংগ্রাম, আর তার ফলস্বরূপ অর্জিত স্বাধীনতা—এ সব কিছু আজও আমাদের বুকে গর্বের সাথে বয়ে চলছে।
বাংলা ভাষার গুরুত্ব
বাংলা, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা, যেটি শুধু আমাদের পরিচিতি নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনশৈলীর অংশ। আজ বিশ্বে প্রায় ৩২ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তবে, প্রশ্ন হলো—কেমন হচ্ছে এই ভাষার ব্যবহার? বিশেষত লেখার ক্ষেত্রে? সঠিক বানান লিখতে পারছেন ক’জন? এই প্রশ্ন আজও অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) তার সময়েই বলেছিলেন, ‘পাঁচ কোটি বাঙালির অধিকাংশই বানান ভুল করে।’ তাঁর আমলের পর থেকে এখন বাঙালির সংখ্যা অনেক বেড়েছে, এবং আজকের দিনে আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক
গোষ্ঠী। কিন্তু এখনও আমরা একমত হতে পারিনি আমাদের ভাষার বানান বিষয়ে।
বাংলা ভাষার বর্ণমালা এবং সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষার বর্ণমালা যেমন বিশাল, তেমনি এটি অতি সঠিকভাবে রচনা করাও এক বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলা ভাষায় রয়েছে ১১টি স্বরবর্ণ, ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ, মোট ৫০টি অক্ষর, সঙ্গে রয়েছে কার চিহ্ন, যুক্তবর্ণ ইত্যাদি। যে কারণে, বানান লিখে ভুল হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। “ই” এবং “ঈ”, “উ” এবং “ঊ”, “ন” এবং “ণ”, “স” এবং “শ”, “ষ” ইত্যাদি একই বর্ণের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্ট হয়, এবং এটা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এই কারণে, অনেকেই ইংরেজি হরফে বাংলা লেখেন, এবং বানান সংশোধনের জন্য সাহায্য পাওয়া যায় না।
এটি শুধু আমাদের জন্য নয়, বিশ্বে বাংলার গ্রহণযোগ্যতা তৈরির ক্ষেত্রেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি বাংলার লিখিত রূপ সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় না হয়, তাহলে বিদেশিদের কাছে এই ভাষার গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কঠিন।
ভাষার লিখিত রূপ সংস্কারের প্রয়োজন
আমরা আজও বাংলা ভাষার বানান নিয়ে বিভ্রান্ত। “স”, “শ”, “ষ”, “ই”, “ঈ”, “উ”, “ঊ”, “ন”, “ণ”, “জ”, “য” ইত্যাদি বর্ণগুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই বিভ্রান্তির কারণে অনেকেই বাংলা লেখায় পিছিয়ে আছেন। অনেক মানুষ ইংরেজি হরফে বাংলা লেখেন, যাতে বানান ভুলের আশঙ্কা থাকে না। তবে, এটি একটি অস্থায়ী সমাধান।
একটি ভাষার লিখিত রূপ যদি সহজ ও সঠিক না হয়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব নয়। বাংলা ভাষার লিখিত রূপ সহজতর করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ:
• “স”, “শ”, “ষ” → একটি রাখা (শুধু ‘স’ বা ‘শ’)
• “ই”, “ঈ” → একটি রাখা (শুধু ‘ই’)
• “উ”, “ঊ” → একটি রাখা (শুধু ‘উ’)
• “ন”, “ণ” → একটি রাখা (শুধু ‘ন’)
• “জ”, “য” → একটি রাখা (শুধু ‘জ’)
এ ধরনের পরিবর্তন আনলে বাংলা ভাষার লিখিত রূপ আরও সহজ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।
বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান যুগে বাংলা ভাষার পরিসর আরও বিস্তৃত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার উন্নয়ন। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার শক্তিশালী উপস্থিতি দরকার। আমরা যদি বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষা তৈরি করি, তাহলে তা শুধু বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য নয় বরং সারা বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রযুক্তি শিল্প ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। এর জন্য প্রয়োজন একটি নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা, যা বাংলা ভাষায় তৈরি হবে। বাংলায় প্রোগ্রামিং শেখানো হলে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম আরও সহজে প্রযুক্তি শিখতে পারবে এবং তাদের অভ্যস্ত ভাষায় এই বিষয়গুলি আরও কার্যকরভাবে রপ্ত করতে পারবে।
প্রযুক্তি জগতেও বাংলা ভাষার প্রয়োগ উন্নত করতে বাংলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং ভাষা তৈরি হলে নতুন একটি সিনট্যাক্স, ব্যাকরণ, এবং ভাষাগত কাঠামো প্রয়োজন হবে, যা বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলা ভাষার জন্য কিছু পরামর্শ
• বাংলা ভাষার লিখিত রূপ সহজ ও সঠিক করার জন্য বর্ণমালা সংস্কার করা উচিত।
• প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও প্রোগ্রামিং ভাষার সাহায্য নিতে হবে।
• শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এবং দৈনন্দিন জীবনে বাংলার ব্যবহার আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
• আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলার প্রচার ও প্রসার বাড়ানোর জন্য অনুবাদ এবং ভাষা শিক্ষার অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা উচিত।
• বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং (ML) ব্যবহার করে অটোকারেকশন, গ্রামার চেকার, এবং ট্রান্সলেশন
সিস্টেম উন্নত করা যেতে পারে।
উপসংহার: বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ ও আমাদের করণীয়
বাংলা ভাষা শুধু একটি ভাষা নয়, এটি আমাদের পরিচয়, গর্ব এবং আবেগের প্রতীক। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাখতে হলে আমাদের উচিত বাংলাকে আরও সহজ, আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপন করা। আমরা যদি বাংলাকে প্রযুক্তির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে তা শুধু আমাদের ভাষার গৌরবই বাড়াবে না, বরং প্রযুক্তি জগতে আমাদের অবস্থানকে আরও মজবুত করবে। বাংলা ভাষার সহজিকরণ, ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারের আধুনিকীকরণ, প্রোগ্রামিং ভাষার বিকাশ, প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার, এবং AI ও ML-র সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দরবারে বাংলাকে ইংরেজির মতো শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
সকল শহীদ স্মরণে: ভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]