১৭৮৭ সালের ১ মে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহ জেলা। এরপর ১৮১১ সালে ময়মনসিংহ শহর হিসেবে পদমর্যাদা লাভ করে। শহরের জন্য জায়গা দেন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ রঘুনন্দন আচার্য। ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল কৃষ্ণপুর, চরপাড়া, ইটাখলা ও কাশর এই চারটি এলাকা নিয়ে নাসিরাবাদ পৌরসভা স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন করে এর নাম হয় ময়মনসিংহ মিউনিসিপালিটি। শুরুতে এর লোকসংখ্যা ছিল আট হাজার ৫০০ জন। ১৯০১ সালে এই লোকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৬৬৮ জন। ১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহ পৌরসভার লোকসংখ্যা ছিল এক লাখ ৭ হাজার ৮৬৩ জন।
২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা নিয়ে ময়মনসিংহকে দেশের অষ্টম বিভাগ ঘোষণা করেন। একই বছরের ১৩ অক্টোবর গেজেট প্রকাশের মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিভাগের। ১০ হাজার ৬৬৮ বর্গ কিলোমিটারের এই বিভাগে জনসংখ্যা ১ কোটি ২২ লাখের বেশি।
প্রথম শ্রেণির ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়েছে ২০১৮ সালের অক্টোবরে। ২ দশমিক ১৫ বর্গমাইলের ময়মনসিংহ পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়ে এর আয়তন দাঁড়ায় ৯১ দশমিক ৩১৫ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা ২১ থেকে বেড়ে হয় ৩৩টি। আর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট লক্ষাধিক।
প্রায় ১০ বছর আগে ময়মনসিংহ বিভাগ হলেও তেমন সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। সময়ের ব্যবধানে নগরীতে চাপ বেড়েছে মানুষের। সড়কগুলো প্রশস্ত না হওয়া, নগরীর ভেতর দিয়ে রেললাইন যাওয়ায় চলাচল দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন স্থানে যানজট তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। ফলে ভোগান্তি মানুষের পিছু ছাড়ছে না।
- আরও পড়ুন:
- বাধ্যতামূলক হচ্ছে অটোরিকশার নিবন্ধন-চালকের লাইসেন্স
- ব্রিজ পার হতেই লেগে যায় তিন ঘণ্টা!
- অবৈধ দখলে গলিতে রূপ নিয়েছে সড়ক
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ ২০২৩ সালের অক্টোবরে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করা হয়। তিন লাখের বেশি মানুষের বসবাস, এমন সব শহরে গাড়িতে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে কত সময় লেগেছে, সেসব তথ্য গুগল ম্যাপ থেকে সংগ্রহ করে গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের তালিকায় ময়মনসিংহ নবম অবস্থানে রয়েছে। এই তথ্য অনুযায়ী বোঝা যায়, প্রতিদিন যানবাহনের কারণে নগরবাসী কতটা ভোগান্তি পোহাচ্ছ।
ধীরগতির এই শহর নিয়ে নানাভাবে বিভিন্ন সময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। থেমে থাকেনি ময়মনসিংহের সংস্কৃতিজনরাও। তারা শহরকে ‘ধীরগতির দুর্গতি’ নামে প্রতিবাদী কর্মসূচির আয়োজন করে। সবাই যানজট থেকে নিস্তার পেতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর জোরালো ভূমিকার দাবি জানান। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
সরেজমিনে শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাটগুদাম, চরপাড়া, গাঙ্গিনারপাড়, ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকা, নতুন বাজার, জিলা স্কুল মোড়, টাউন হল মোড় ও আকুয়া মাদরাসা কোয়ার্টার এলাকায় যানজট বেশি। এসব এলাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানবাহনের ভিড় লেগে থাকে। বিশেষ করে স্কুল ছুটির পর দুপুরে শহরের নতুন বাজার, জিলা স্কুল মোড়, টাউন হল মোড় এলাকায় শত শত তিন চাকার যান যানজট তীব্র করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীতে চলাচলের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত ১২ হাজার তিন চাকার যান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অবৈধভাবে চলে এর দ্বিগুণ। সরু সড়কে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, বাস এবং লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। লাইসেন্সপ্রাপ্ত লাল ও সবুজ রঙে চিহ্নিত ইজিবাইকগুলো জোড়-বিজোড় সংখ্যায় ভাগ হয়ে একদিন পরপর পর্যায়ক্রমে চলাচল করার নিয়ম থাকলেও চালকরা প্রতিদিন চালাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ রাতারাতি ইজিবাইকের রং বদলে ভুয়া নম্বর ব্যবহার করে প্রতিদিন চালাচ্ছেন। ফলে যানজট থেকে রেহাই মিলছে না।
এদিকে নগরীর কেওয়াটখালী থেকে গুমটি পর্যন্ত ১০টি রেলক্রসিং। এসব রেলক্রসিং পার হয়ে প্রতিদিন ২৬টি ট্রেন ৪৭ বার চলাচল করে। কর্মক্ষেত্রে ছুটে চলা মানুষের এ যেন বড় প্রতিবন্ধকতা। ট্রেনের সিগন্যালে ব্যস্ত সড়কের যানচলাচল মুহূর্তেই স্থবির হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় যানজটের। এছাড়া অনেক রেলক্রসিংয়ে নেই গেট ব্যারিয়ার। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। শহরের ভেতর থেকে রেললাইন অন্যত্র সরানোর দাবি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে পালন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। কিন্তু বাস্তবে সুফল পায়নি নগরবাসী।
নগরীর নয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যানজট এখন নিত্যদিনের চিত্র। ফলে শিক্ষা-সংস্কৃতির ময়মনসিংহকে এখন যানজটের শহর বলা হয়। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জোড়ালো পদক্ষেপের মাধ্যমে যানজট নিরসন করবে, এমনটাই চাওয়া।
চরপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইয়াসিন আরাফাত টুটুল বলেন, এই এলাকায় সারাদিনই যানজট থাকে। চরপাড়া মোড়ে কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ দ্বায়িত্ব পালন করলেও যানজট নিরসন হচ্ছে না। সড়কের ফুটপাত দখলমুক্ত করা প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব সামসুদ্দোহা মাসুম বলেন, অতিরিক্ত ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কারণে রাস্তা দিয়ে মানুষের হেঁটে যাওয়ার অবস্থা নেই। চারদিকে ইজিবাইক আর রিকশা। আতঙ্কের মধ্যে চলাচল করতে হয়। এছাড়া নগরীর ভেতর দিয়ে নম্বর প্লেটবিহীন অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। হাসপাতালে রোগী নেওয়ার কথা বলে এসব গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
ময়মনসিংহ ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক (প্রশাসন) আবু নাছের মো. জহির বলেন, ময়মনসিংহ পুরোনো শহর। এখানকার সড়ক অপ্রশস্ত। গত চার দশকে সড়ক প্রশস্ত হয়নি। কিন্তু যানবাহন বেড়েছে বহুগুণ। তাই এই শহর এখন যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে। যানজট নিরসনে সওজের রাস্তাগুলো প্রশস্তকরণের বিকল্প নেই। এছাড়া রেলক্রসিং অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তবে ট্রাফিক পুলিশ যানজট কমাতে চেষ্টার কমতি রাখছে না।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ বলেন, পুরোনো সড়কগুলো প্রশস্ত করা যাচ্ছে না। এরমধ্যে ফুটপাতও দখল করা হয়। সিটির ভেতরে শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চলাচল করাতে আমাদের তদারকি রয়েছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলমান।
কামরুজ্জামান মিন্টু/জেডএইচ/এএসএম