যারা আমার বুক খালি করেছে তাদের বিচার চাই

1 month ago 7

হামিদুর বেঁচে নেই এখনো বিশ্বাস হয় না। তার কথা মনে পড়লে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। সন্ধ্যার পর ছুটে যাই কবরস্থানে। ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলি দীর্ঘসময়। মৃত্যুর আগে তাকে যে কথা বলা হয়নি, সব কথা বলতে থাকি। জানি না ছেলে সব কথা শুনে কিনা। সে রুটি খুব পছন্দ করতো। ছেলে নেই বলে গত এক বছর বাসায় রুটি বানাইনি।

কথাগুলো বলছিলেন চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হামিদুর রহমান সাদমানের (২০) মা কাজী শারমিন আক্তার। কুমিল্লা নগরীর রাজাগঞ্জের গোয়াল পট্টির নিজ বাসায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন তিনি।

কাজী শারমিন আক্তার বলেন, যেদিন আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন, একজন মা হিসেবে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের প্রতি ঘৃণা বেড়ে যায়। এরপর আমি ছেলেদের সাহস যুগিয়েছি।

শহীদ হামিদুর রহমান সাদমান কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়ারা ইউনিয়নের দিঘলগাঁও মজুমদার বাড়ির বাহরাইন প্রবাসী ইকবাল মজুমদারের ছেলে। তিনি কুমিল্লা সিসিএন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে করে ২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় ইন্টার্ন করতে যান।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের খবরে রাজধানীর শাহবাগে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে কেরানীগঞ্জ থেকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে বংশাল থানার সামনে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে ছাত্র-জনতা। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলি এসে লাগে হামিদুরের বুকে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গত ১৫ জানুয়ারি জুলাই অভ্যুত্থানে যে ৮৩৪ জন শহীদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে, সেই তালিকার ৬২৩ নম্বরে রয়েছে হামিদুর রহমানের নাম। তার মেডিকেল কেস আইডি ২২৭৪১।

হামিদুরের মা কাজী শারমিন আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছেলে হত্যার ঘটনায় আমি বাদী হয়ে গত ৯ সেম্টম্বর রাজধানীর বংশাল থানায় একটি হত্যা মামলা করি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ আমার ছেলের রক্তমাখা গেঞ্জি-প্যান্ট নিয়ে গেছে। এছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এরপর গত ২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও একটি মামলা করি। মৃত্যুর ১১ মাস অতিবাহিত হলো এখনো বিচারকার্যক্রম শুরু হয়নি। ছেলে হারানোর বেদনা কত কষ্টের তা আপনাদের বুঝাতে পারবো না। আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি চাই। যারা আমার বুক খালি করেছে আমি তাদের বিচার চাই। বর্তমান সরকারের কাছে একইটাই দাবি, যারা আমার ছেলেসহ এই আন্দোলনে যতজনকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে তাদের গ্রেফতার করে বিচার কার্যক্রম দ্রুত শুরু করুন।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের পর বিকেলে শাহবাগে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে কেরানীগঞ্জ থেকে গেঞ্জি পরে বিকেল ৪টায় বন্ধু রাফিসহ বের হয় হামিদুর। মিছিল নিয়ে বংশাল থানার সামনে এলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এসময় পুলিশের গুলি এসে লাগে তার বুকে। বুক ঝাঁজরা করে গুলি বেরিয়ে যায়। ওই সময় রাফি ও আল আমিন নামে একজন ছাত্র তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে যায়। বিকেল ৫টায় চিকিৎসকরা জানান সে মারা গেছে। মৃত্যুর আগে তিনবার মাকে ডেকে ছিল সাদমান। তার বন্ধুরা অ্যাম্বুলেন্সে করে কুমিল্লা শহরের দেশোয়ালি পট্টিতে তার নিথর দেহ নিয়ে রাত সাড়ে ৮টায় আমাদের বাসায় পৌঁছায়।

কাজী শারমিন আক্তার আরও বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে এটা ভেবে গর্ব হয়। মনকে শক্ত করি। এই দেশে যখনি কোন স্বৈরাচার সরকার আসবে তখনই আমার মতো মায়েরা তাদের সন্তানদের আন্দোলনে পাঠিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটাবে। এই দেশ আমার আপনার সকলের। আর কখনো যেন অত্যাচারী সরকার না আসে, কোনো মায়ের বুক খালি না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখার অনুরোধ।

শহীদ হামিদুরের ছোট ভাই এইচএসসি পরীক্ষার্থী আশরাফুল আমিন সাফি বলেন, আম্মু সারাদিন ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করেন। ভাইয়ের পুরানো ছবি দেখে সময় কাটান। ২৫ জুলাই ঢাকায় যাওয়ার সময় নতুন গামছা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। আমি বলছি আমি নেবো আর ভাইয়া বলছে সে নেবে। আম্মুও ভাইয়াকে দিতে বলল। তখন আমিও দিয়ে দিলাম। কিন্তু ভাইয়া গামছা নেয়নি। ওই গামছাটি ভাইয়ার মৃত্যুর পর বাড়িতে এলে মাথার নিচে দেওেয়া হয়। রক্তে রঞ্জিত হয়। সেই স্মৃতি এখন আমাকে কাঁদায়।

এমএন/জিকেএস

Read Entire Article