ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্ন বহু দশক ধরে বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এখনো সেই স্বীকৃতি দেয়নি। এর ফলে শুধু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্নই বিলম্বিত হচ্ছে না, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও এর গভীর প্রভাব পড়ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বনাম মার্কিন অবস্থান
১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্মের পর থেকেই ফিলিস্তিনকে ঘিরে স্বাধীনতার আন্দোলন চলমান। ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে ‘সদস্যবহির্ভূত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে প্রায় ১৪৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ পেতে যুক্তরাষ্ট্র বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ প্রস্তাব তোলা হলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে ভেটো দেয়।
ওয়াশিংটনের যুক্তি হলো, ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক চাপ বা একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয়, বরং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে। তাদের দাবি, অন্যথায় এ স্বীকৃতি শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে।
‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির অজুহাত
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ আলোচনার মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। অসলো চুক্তি থেকে শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন সব সময় এই নীতির প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ইসরায়েলকে সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী করেছে, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে আরও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক নয়, গভীর কৌশলগত ও সামরিক জোটে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে মার্কিন সেনা সহায়তা, আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ, গোয়েন্দা সহযোগিতা ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। এ কারণে ফিলিস্তিনকে একতরফা স্বীকৃতি দিলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে— এই ভয়ে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিতে চায় না। ইসরায়েলপন্থি শক্তিশালী লবিগুলো, বিশেষত এআইপিএসি, মার্কিন প্রশাসনকে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির মতো সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখে।
ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিভাজন
যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকেও অবিশ্বস্ত ও অক্ষম হিসেবে তুলে ধরে। পশ্চিম তীরে ফাতাহ ও গাজায় হামাসের মধ্যে বিভাজনকে স্বীকৃতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করে। তাই তাদের মতে, ফিলিস্তিন এখনো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রস্তুত নয়। গাজা ও পশ্চিম তীরে মানবিক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা এ ধারণাকে আরও জোরালো করে।
আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ২০২৪ সালে বলেছে, ১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব অবৈধ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই রায়ের ওপর কোনো গুরুত্ব দেয়নি। একইভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ারও উপেক্ষা করে। ফলে আন্তর্জাতিক আইন যতই ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তিশালী হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে সেই দাবিকে অগ্রাহ্য করছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জনমত
মার্কিন রাজনীতির ভেতরেও ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিভক্তি রয়েছে। রিপাবলিকানরা ইসরায়েলপন্থি এবং ফিলিস্তিন স্বীকৃতির ঘোর বিরোধী। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটদের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে ক্রমেই জোরালো কণ্ঠ তুলছে। তবে দলটির নেতৃত্ব সতর্ক অবস্থান নেয়, যাতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কংগ্রেসের ভারসাম্য ও জনমত— সব মিলিয়ে মার্কিন প্রশাসন সহজে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় না।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি শুধু ইসরায়েল নয়, বরং মিসর, জর্ডান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। এসব আরব দেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও বাস্তবে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। এই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখছে, যাতে ফিলিস্তিন প্রশ্নে কোনো কার্যকর পরিবর্তন না আসে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ ও জাতিসংঘের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরে প্রগতিশীলদের চাপ এবং জনমতের পরিবর্তন ভবিষ্যতে মার্কিন নীতি পরিবর্তনের পথ খুলে দিতে পারে। তবে রিপাবলিকান বিরোধিতা, শক্তিশালী ইসরায়েলপন্থি লবি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত স্বার্থ এ পথে বড় বাধা হয়ে আছে।
পরিশেষে
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাধা হলো তার ইসরায়েলনির্ভর নীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব এবং ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক দায়বদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন এখনো আলোচনার অজুহাত তুলে ফিলিস্তিনের স্বপ্নকে বিলম্বিত করছে। তবে বৈশ্বিক চাপ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা যদি পাল্টে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকেও হয়তো এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হতে হবে।