রাশেদ হোসেন রনি জামার্নির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। পড়বেন স্লেভারি স্টাডিজ বিষয়ে। তিনি কুমিল্লার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তার উচ্চশিক্ষার আদ্যোপান্ত নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই—
রাশেদ হোসেন রনি: আমি কুমিল্লার কালীর বাজার ইউনিয়নের হাতীগাড়া গ্রামের সন্তান। লালমাই পাহাড়, কুমিল্লা সেনানিবাস ও বিজিবির পার্শ্ববর্তী এলাকা, কোটবাড়ি বার্ড, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, শালবন বিহার—এসব এলাকায় কেটেছে শৈশব। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ইত্যাদিসহ গ্রামীণ অনেক খেলার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। কলেজে ওঠার আগপর্যন্ত একাডেমিক দিক থেকে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলাটা ভালোবাসতাম। তাই স্বপ্ন দেখতাম একসময় খেলাধুলা করে বড় মাপের ক্রিকেটার হবো। আমার জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। পারিবারিক অবস্থার কারণে জীবনে অনেক শখের জিনিস মা-বাবার কাছে আবদার করতে পারিনি। তবে মা-বাবার কাছে সামর্থের মধ্যে আবদার করলে কখনো নিষেধ করেননি।
জাগো নিউজ: কী ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
রাশেদ হোসেন রনি: পড়ালেখার পাশাপাশি অনেক কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজও করেছি। কলেজে পড়াশোনা করার সময় নিজ গ্রামভিত্তিক একটি সামাজিক সংগঠন ‘বন্ধু সমাজ’র সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করি। নিজ ইউনিয়নের সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘হ্যান্ডস ফর হিউম্যানিটি’ সংগঠনে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরে কাজ করা হয়েছে অনেক সংগঠনের সাথে। দায়িত্ব পালন করেছি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইটি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি ও কুমিল্লা জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে। তা ছাড়া সেচ্ছায় রক্তদানের জন্য সাধারণ সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলাম ‘বাঁধন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা’র সঙ্গে। পাশাপাশি প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তঃবিভাগ প্রতিযোগিতায় বাংলা বিভাগের হয়ে মাঠে নেমেছি ফুটবল, ক্রিকেট ও ভলিবল টিমে। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটিতে থাকা অবস্থা কয়েকটি অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে।
জাগো নিউজ: জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার ভাবনা মাথায় এলো কীভাবে?
রাশেদ হোসেন রনি: শৈশবে স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়া। সেই স্বপ্নটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেও ছাড়তে পারিনি। গিয়েছিলাম ধানমন্ডির আবাহনী ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু আবাসিক হলবিহীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর জন্য ক্রিকেট অ্যাকাডেমির মাসিক খরচ ও প্র্যাকটিসের শিডিউল ঠিক রাখা প্রায় অসম্ভব বিষয়। তখনই শেষ হয়ে যায় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের পড়াশোনায় মন বসাতে পারিনি। তারপরই ভাবনা আসে বিদেশে উচ্চশিক্ষার। বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই অন্য কোনো দেশে ব্যাচেলর করতে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি। মনে হচ্ছিল যে কোনো সাবজেক্ট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় হোক; বিদেশ চলে যাবো। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম জার্মানিতে ব্যাচেলরের জন্য আবেদন করবো। শুরু হলো আইইএলটিএস কোচিং করা। ৩-৪ মাসের প্রিপারেশন নিয়ে আইইএলটিএস পরীক্ষায় পেলাম ৫.৫ স্কোর। এটি দিয়ে জার্মানিতে ব্যাচেলরের জন্য আবেদন শুরু করি। জার্মানিতে ব্যাচেলরে আবেদনের জার্নিটাতে সাথে ছিল বাংলা বিভাগের বন্ধু আরিফ। আরিফের সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড ও আইইএলটিএস স্কোর ৬.০ থাকায় সে জার্মানির কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার না পেয়ে জার্মানির আশা ছেড়ে দিই। আরিফ চলে যায় জার্মানিতে। শেষে বাংলা বিভাগ থেকেই ব্যাচেলর শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু তখনো বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা থেমে থাকেনি। অ্যাকাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়েছি আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রিপারেশন। একপর্যায়ে পরিবার থেকে ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ দিতে কষ্ট হওয়ায় জ্ঞানগৃহ-নবদূত প্রকাশনীতে পার্ট টাইম চাকরিতে জয়েন করি। তখন নিজের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণ। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কাজ, বিভাগের পড়াশোনা, প্রকাশনীতে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। পাশাপাশি আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রিপারেশন ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি চলে।
জাগো নিউজ: জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ার গল্প শুনতে চাই—
রাশেদ হোসেন রনি: জার্মানিতে যদিও কোনো টিউশন ফি নেই কিন্তু জার্মান অ্যাম্বাসি ফেস করার দীর্ঘ ওয়েটিং পিরিয়ড বিদ্যমান। তাই ২০২২ সালে জার্মান অ্যাম্বাসিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য একটা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখি। লম্বা ওয়েটিং পিরিয়ড চলাকালীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করে ফেলি। জার্মানিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স করার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। বাংলা বিভাগে পড়ার কারণে জার্মানিতে মাস্টার্সে আবেদনের জন্য রিলেটেড সাবজেক্ট পাওয়া কঠিন এক বিষয়। তা ছাড়া আমার সিজিপিএ ছিল খারাপ। এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবরে আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে সেখানেও আশানুরূপ স্কোর তুলতে পারিনি। ভেবেছিলাম আরেকবার আইইএলটিএস পরীক্ষা দেবো। তবে এরমধ্যেই সিজিপিএ ২.৯৭ ও আইইএলটিএস ৬.০ দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার চেষ্টা করি। শেষ পর্যন্ত জার্মানির মোট ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামে আবেদন করতে পেরেছিলাম। এরমধ্যে ইউনিভার্সিটি অব বন থেকে শেষ মুহূর্তে এসে অফার লেটার পেয়ে যাই। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার ক্ষেত্রে আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছে এক সিনিয়র ভাই, যার অবদান আমি কখনো ভুলতে পারবো না। বন ইউনিভার্সিটি থেকে অফার লেটার পাওয়ার পর ভাই যেমন অবাক ও খুশি হয়েছে, আমারও অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা ছিল না! কারণ শুধু জার্মানিতে নয়, বিশ্বে ইউনিভার্সিটি অব বন উল্লেখযোগ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যার ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং একশর মধ্যে। বাংলা বিভাগে পড়ে কম সিজিপিএ ও আইইএলটিএস স্কোর নিয়েও এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে আমি অনেক আনন্দিত। জার্মানি আসার প্রস্তুতির পুরোটা সময় আমি একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয়ে গেছি। প্রার্থনা করেছি যেন আল্লাহর রহমতে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হয়ে যায়। তা ছাড়া আমার মা-বাবা, ভাই-বোন ও পরিচিতজনদের দোয়া ছাড়া এ যাত্রায় আমি কখনোই সফল হতে পারতাম না।
জাগো নিউজ: জার্মানিতে পড়াশোনার সুযোগ পেতে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে?
রাশেদ হোসেন রনি: বন ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর ব্লক অ্যাকাউন্টের টাকা জোগাড় করা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। জার্মানিতে টিউশন ফি না থাকলেও বাংলাদেশ থেকে ১১ হাজার ৯০৪ ইউরো জার্মানিতে পাঠিয়ে দিতে হয়। যদিও পরে জার্মানি পৌঁছালে সেই টাকা ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হয়। আবার কোনো কারণে যদি কারো ভিসা না হয়, তাহলে তার টাকা আবার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন ইউভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর যখন আমার ব্লক অ্যাকাউন্টের টাকা প্রয়োজন; তখন বাড়িতে আম্মু-আব্বুকে জানাই। কিন্তু নিজের ঘরে তখন লাখখানেক টাকাও নেই। অথচ আমার প্রয়োজন প্রায় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এমতাবস্থায় আমার আপুরা ও আমার ভাই প্রয়োজনে বাবার জমি বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। এদিকে আম্মা আমাদের আত্মীয়দের কাছে টাকা ধার চাওয়া শুরু করেন। আমার খালামনি, মামা, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, বন্ধু ও পরিচিতজনদের থেকে ধার করে। শেষ পর্যন্ত ব্লক অ্যাকাউন্ট টাকা জোগাড় করতে সক্ষম হই। যারা ওই মুহূর্তে আমাকে সহযোগিতা করেছে তাদের উপকার আমি কখনো ভুলবো না।
জাগো নিউজ: জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে কীভাবে আবেদন করতে হয়?
রাশেদ হোসেন রনি: জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের আগে নিজের স্টাডি ফিল্ড-সংশ্লিষ্ট সাবজেক্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করা জরুরি। এ জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট হলো DAAD.DE। এ ছাড়া mygermanuniversity ওয়েবসাইটিও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবজেক্ট খোঁজার পর দেখতে হবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আবেদন করা যায়, নাকি UniAssist এর মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। UniAssist হলো একটি মাধ্যম। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ডকুমেন্টস যাচাই-বাছাই করে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন গ্রহণ করে। জার্মানিতে সামার ও উইন্টার মৌসুমে আবেদন করা যায়।
জাগো নিউজ: জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে?
রাশেদ হোসেন রনি: ইউনিভার্সিটি অব বন থেকে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো ট্রান্সপোর্টেশন ফ্রি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ড দিয়ে যে কোনো শিক্ষার্থী পুরো জার্মানি ঘুরতে পারবে। কোনো টাকা দেওয়া লাগবে না। শুধু বন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জার্মানির শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগটি আছে। তা ছাড়া জিমনেসিয়াম, খেলাধুলা কিংবা জার্মান ভাষা শেখানোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয়। আবার জার্মানিতে যে কোনো শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পেয়ে থাকেন।
এসইউ/জেআইএম