জুলাই বিপ্লবে অবদানের জন্য অনেকেই নানাভাবে ভূষিত করা হলেও মনে করা হয়নি আরেক যোদ্ধা মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে এমনটা দাবি করেন তিনি। এছাড়াও সেই স্ট্যাটাসে অভিমান প্রকাশ করে অনেক কিছু বলেন মোসাদ্দেক।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন যাবৎ ফেসবুক জুড়ে বিভিন্ন পোস্ট, কমেন্টে শুভানুধ্যায়ীরা ব্যাপক মেনশন দিচ্ছেন— ৫ আগস্টের পর আমি কোথাও নাই, কেন নাই, কীভাবে নাই বিষয়গুলো জানতে চাচ্ছেন, আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। বিশেষত টিভি টকশো, সমন্বয়কদের জেলায় জেলায় যাত্রা, সচিবালয় পাড়ায় আমার অনুপস্থিতি। বিষয়গুলো কখনোই লেখব না ভেবেছিলাম— কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের দাবি থেকে কিছুটা হলেও লিখতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাজীবনের শুরুর কিছুটা পর থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া ও দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ক্যাম্পাসে এক্টিভিজম করা শুরু করি। এখানের প্রতিযোগিতামূলক আবহের মধ্যে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে নাহিদ ইসলামদের সাথে পরিচয়ের সখ্যতা হওয়ার আগেই দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যদিও তখনো আমি নাহিদ ইসলামদের ভালোভাবে চিনতাম না। পরবর্তীতে তাদের সম্পর্কে জানা হলেও পারস্পরিক আলাপ বা সাক্ষাৎ কখনো গড়ে ওঠেনি। দূরত্বটাই ছিলো প্রকট।
৫ জুন কোটা পুনর্বহালের রায় দিলে ওনারা সবার আগে প্রতিবাদী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। [অন্যান্য একটিভিস্ট গ্রুপগুলোও আলাদা কর্মসূচি ঘোষণা করে। আমাদেরও স্টিয়ারিং নিজের হাতে রেখে আন্দোলন কন্টিনিউ করার সামর্থ ছিলো] ওনাদের সাথে দূরত্ব থাকা সত্বেও জাতীয় ও বৃহত্তর স্বার্থকে চিন্তা করে বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেই। পরবর্তীতে জুলাই এর শুরুর দিকে একদিন আন্দোলনের মাঝে নাহিদ ইসলাম আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে আলাপ চলাকালে বলেন যে, তোমার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত ঝামেলা থাকতে পারে তবে এটা তো জাতীয় ইস্যু। দেশ ও জাতির স্বার্থে আমাদেরকে সবাই মিলে আন্দোলন সফল করতে হবে।
এরপর থেকে কর্মসূচিগুলোতে শুধু সাধারণ আন্দোলনকারী হিসেবে অংশগ্রহণ না করে মিছিলের শৃঙ্খলা রক্ষা, স্লোগান দেওয়া, স্বেচ্ছাসেবী কাজ করা ইত্যাদির মতো নেতৃত্ব পর্যায়ের কাজগুলো করি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে ১৫ জুলাই বিজয় একাত্তর হলের সামনে, ১৬ জুলাই শহিদ মিনারের সমাবেশ বাস্তবায়ন, ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজায় বাস্তবায়নে সামনে থেকে ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছিলো। জুলাই এর প্রতিদিনই কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে ছিলাম। এটা অহংকার বা দম্ভ না— ধ্রুব সত্য।
বিন্দুকের মুখেই হোক বা স্বপ্রণোদিত হয়েই, কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল কেউ আবার সরকারের সাথে আপোষ করে নিয়েছিলো— গা বাঁচানোর স্বার্থে। নাহিদ ভাইসহ কিছু সমন্বয়কদের ডিবিতে রেখে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে বিবৃতি দেওয়া হলো তখন কারফিউ ভেঙে পূর্বঘোষিত ৯ দফা ও নাহিদ ইসলামদের মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মিছিলরত অবস্থায় আমরা গ্রেফতার হলাম। এরপর আমাকে এবং আবিদ হাসান রাফিকে ডিবিতে একদিন গুম করে রাখলো। পরিবার থেকে ডিবিতে বারবার যোগাযোগ করা হলেও সন্ধান দেওয়া হয়নি। [ঐদিন আমাকে সহ আরও ১৪ জন শিক্ষার্থীকে ডিবিতে আনা হয়েছিলো।] ২ আগস্ট বিভিন্ন মসজিদ থেকে বাদ জুমা বিক্ষোভ মিছিল বের করে পুনরায় আন্দোলনকে চাঙা করা, ৪ ও ৫ আগস্ট শাহবাগ দখল করতে সামনে থেকে ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছে। [বলে রাখা ভালো— এবি যুবাইর এবং আবিদ হাসান রাফি ৪ ও ৫ আগস্ট শাহবাগ দখলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, আর অন্যান্য সমন্বয়কেরা শাহবাগে কখন উপস্থিত হয়েছে তা সেদিন উপস্থিত ছাত্র-জনতা ভালো করেই অবগত।] পুরোদস্তুর মাঠকর্মী ও সামনের সারি থেকে মোকাবিলা করেছি পুলিশ ও ছাত্রলীগের হায়েনাদের।
৩ আগস্ট শহিদ মিনারে লাখো লাখো মানুষের জনসমুদ্রে স্থান নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ৫ আগস্টের উত্তাল জনসমুদ্রের ক্ষুদ্র মঞ্চে বিজয়ের ঐতিহাসিক মুহুর্তের সাক্ষী ছিলাম। জনতা নাহিদ ইসলামকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলো। তিনি ভাষণ দিয়ে সবাইকে গণভবন অভিমুখে মার্চ করতে বললেন। আমি একজনের মাধ্যমে জেনে তাকে অবগত করালাম যে জনতা ইতোমধ্যে গণভবনে প্রবেশ করেছে। এরপর কিছুক্ষণ তিনি জনতার সাথে অভিবাদন বিনিময় করলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন গণভবনে যাওয়ার জন্য একটা রিকশা ম্যানেজ করতে পারি কি না দেখতে। শাহবাগের চার রাস্তায় লাখো লাখো মানুষের ঢল! এর মধ্যে তিল ধারণের ঠাই নাই— রিকশা পাওয়ার তো সুযোগ নেই। অনেককে কানেক্ট করার চেষ্টা করলাম— কিন্তু নেটওয়ার্ক জ্যাম থাকার কারণে অসুবিধা হচ্ছিল। অবশেষে একটা রিকশা ম্যানেজ করা সম্ভব হলো। বিশাল উত্তাল জনসমুদ্রে ধীরগতিতে সিঁথি কেটে কেটে রিকশা অবশেষে মঞ্চে এসে ভিড়ল।
নাহিদ ইসলাম আমাকে কানেকানে বললেন তিনি, আসিফ আর বাকের উঠবেন রিকশায় আর যেনো কেউ না ওঠে— সম্ভবতঃ এভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে আমার সর্বশেষ আলাপ সম্পন্ন হলো। পথে ঘাটে হঠাৎ হঠাৎ কারো কারো সাথে দেখা হয়ে গেলেও আর কখনো আলাপ হয়নি। সেদিন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার রিকশায় চড়ে বসলেন। তরিকুল ইসলামও কোনোভাবে নিজের স্থান করে নিয়ে উঠে গেলেন। রিকশা জনসমুদ্র ঠেলে জাতীয় সংসদ, গণভবনের দিকে এগিয়ে গেলো। আমি রয়ে গেলাম এপারে, মিশে গেলাম জনতার ভিড়ে! যেন মনে পড়লো সেই গানের লাইন— 'রেখো মাটির পরে দুটি পা রেখো মাটির সাথে দোস্তি'। কিছুদিন মনে হতে লাগলো অনেক-বিশাল-বড় দেশপ্রেমের কাজ করেছি এটাই অনেক। তাই কী করেছি বা না করেছি, স্বীকৃতি বা চাওয়া-পাওয়া কাজ করেনি। অবশ্য ৫ আগস্টের পর অনেকবারই কারো কারো সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো রেসপন্স পাইনি। সংশ্লিষ্ট অনেকেই ফোন ধরেননি, মেসেজ সিন করেননি। এগুলো নিয়ে আমার খুব একটা আফসোস কাজ করতো না শুরুর দিকে। ভাবতাম তেপান্তরে ঘুরে ঘুরে অনেক তো গেলো বেলা এবার অন্তত পড়ার টেবিলে ফেরা হোক! সেটা আজও হয়ে ওঠেনি।
আন্দোলন বিরোধিতাকারী, ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট কিংবা ১৫/১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু ব্যাক্তিদেরকে যখন দেখি আন্দোলনের মূল কারিগর হিসেবে সাব্যস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তখন খারাপ লাগে। অনলাইনে লেখালেখি করার মাধ্যমে আমি আমার জায়গা থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি প্রতিবাদ জানানোর। আন্দোলনের বিভিন্ন দিনের, গতিপথের ভূমিকা নিয়ে যখন দেখি কেউ কেউ এককভাবে ক্রেডিট দাবী করছেন তখন প্রশ্ন জেগে ওঠে, আমি কে? আমরা কে? জনতা কে? শহীদ কে?
সে যাইহোক— ইদানীং অবশ্য সেলিব্রিটি বনে যাওয়, আন্দোলনের একক বা গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার সেজে যাওয়া কেউ কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু দীর্ঘ ৩/৪ মাসের শ্রান্ত সফর শেষে আমি ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে— যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…
আমি বরাবরই রাজপথের লোক। খ্যাতি, যশের ধার ধারি না। অন্যায় যেখানে হবে তার প্রতিরোধে আমাকে পাবেন— রাজপথে দেখা মিলবে, চায়ের আড্ডায় অথবা কোনো অজানা গলিতে। পত্রিকায়, টকশো কিংবা সচিবালয় পাড়ায় আমার দেখা নাও মিলতে পারে। সরল স্বীকারোক্তির অহংকার বা দম্ভ মনে হয়ে থাকলে তবে তাই হোক— মিথ্যার উপর ভর করে ভণ্ডামি করে বেঁচে থাকা আমার ধর্ম বা ধর্মেরও ধর্মও নয়।