বর্তমান শীতকাল চলছে। ঋতুচক্রে শীত, সত্যিই মহান স্রষ্টার অপার মহিমা। শীত অধিকাংশ মানুষেরই প্রিয় ঋতু। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাছে এ মৌসুম আরও প্রিয়। কেননা অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে ইবাদত বেশি করা যায় এবং সহজভাবে আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভ করা যায়। একজন মুমিন তার ইবাদত বন্দেগিতে শীতকালকে অত্যন্ত পছন্দ করে, যার ফলে সে রাত জেগে দীর্ঘ সময় আল্লাহর স্মরণে রত থাকে।
তাই তো মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মুমিনের বসন্তকাল’ (মুসনাদ আহমাদ)। অপর এক বর্ণনায় মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে’ (শুয়াবুল ইমান লিল বায়হাকি)।
আসলে মুমিন সব সময়ই এটা পছন্দ করে যে, কীভাবে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করব, তাই সে চায় কোন ধরনের সুযোগই যেন হাতছাড়া না হয়। নামাজ যেহেতু মুমিনের মেরাজ, তাই নামাজের মাধ্যমেই একজন মুমিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দর্শন লাভ করে। আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, তাহলে দেখতে পাই নামাজ এমন একটি ইবাদত যেখানে আল্লাহপাকের মহিমাগীতি করা হয়, তার প্রশংসা করা হয়, তার পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়, নিজের পাপ ও দুর্বলতা স্বীকার করে আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় এবং মহানবির (সা.) প্রতি আশিস কামনাও করা হয়।
তাই বলা যায় পুরো নামাজই হচ্ছে দোয়া। যেখানে সবকিছুকে একত্রিত করেছে নামাজ, তাহলে কেন এ থেকে আমরা লাভবান হব না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ! আমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং তুমি আমার ইবাদত কর এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামাজ কায়েম কর’ (সুরা তাহা, আয়াত: ১৪)।
নামাজ কায়েমের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন আর বর্তমান আমরা যে মৌসুম অতিবাহিত করছি এখন সবচেয়ে উত্তম সময় সুন্দরভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে তার ইবাদত করার। রাত যেহেতু বড় তাই শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যায় সহজেই আর এই রীতিকে যদি সারা জীবনের স্থায়ী রীতিতে পরিণত করে নিতে পারি তাহলেই হব ধন্য।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়’ (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬৪)।
আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ দিন ও রাতের আবর্তন ঘটান, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা রয়েছে’ (সুরা নূর, আয়াত: ৪৪)।
হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘শীতকাল হলো ইবাদতকারীদের জন্য গনিমতস্বরূপ।’ হজরত আমের ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি মহানবি (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘শীতল গনিমত হচ্ছে শীতকালে রোজা রাখা’ (তিরমিজি)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে শীতল গনিমত কী সেটা বলে দেব না?’ শ্রোতারা বললেন, অবশ্যই। তিনি বললেন ‘সেটা হচ্ছে শীতকালে দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামাজ আদায় করা।’
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে, ‘মহানবি (সা.) বলেছেন, যদি কোনো তীব্র ঠাণ্ডার দিন আল্লাহর কোনো বান্দা বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই), আজকের দিনটি কতই না শীতল! হে আল্লাহ! জাহান্নামের জামহারি থেকে আমাকে মুক্তি দিন।’ তখন আল্লাহ জাহান্নামকে বলেন, নিশ্চয়ই আমার এক বান্দা আমার কাছে তোমার জামহারি থেকে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাকে আশ্রয় দিলাম। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, জামহারি কী? হজরত রাসুল (সা.) বললেন, জামহারি এমন একটি ঘর, যাতে অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞদের নিক্ষেপ করা হবে এবং এর ভেতরে তীব্র ঠাণ্ডার কারণে তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে। (আমালুল ইয়াওম ওয়াল লাইল)।
নিয়মিত শেষ রাতে আরামের ঘুম পরিত্যাগ করে যারা ইবাদত করেন তারা ভালোভাবেই জানেন এই নামাজের স্বাদ ও আনন্দের কথা। কিন্তু যারা শীতকে ভয় পায় আর ভাবে এই শীতে অজু করতে হবে আর অজু করলে না জানি অসুস্থ হয়ে যাই, এমন যারা ভাবে তাদের শরীর পূর্ব থেকেই আসলে অসুস্থ। কেননা, আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর এমন কোনো দায়িত্বভার ন্যস্ত করেন নি যা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমরা যা করতে পারব তা-ই তিনি আমাদের জন্য আবশ্যক করেছেন।
হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে, প্রথমত সংকটকালীন দান, দ্বিতীয়ত গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু’ (আদ দোয়া লিত তাবরানি)।
হজরত রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জানাব না, কিসে তোমাদের পাপ মোচন করবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবে? সাহাবায়ে কিরাম বললেন, অবশ্যই! হে আল্লাহর রাসুল (সা.)। তিনি বললেন, শীতের কষ্ট সত্তে¡ও ঠিকভাবে অজু করা’ (মুসলিম)। তাই এই শীতকালে অজু করার ভয়ে আমরা যেন ইবাদত থেকে বঞ্চিত না থাকি আর একান্তই যাদের ঠাণ্ডার সমস্যা রয়েছে তারা গরম পানি ব্যবহার করুন, তারপরও শীতের রাতগুলোকে কাজে লাগান।
আসলে নামাজ এমন একটি ইবাদত যার সাহায্যে আরবের ধূলি ধূসর মরুভূমির মৃত্যুপ্রায় মানুষের মাঝে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পাষাণ হৃদয়ের মানুষগুলোও কেবল মাত্র নামাজের কল্যাণেই সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হয়ে খোদা লাভের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। সেই পুশু তুল্য মানুষ ফেরেশতায় রূপান্তর হয়েছিলেন কেবল মাত্র নামাজের মাধ্যমেই। তারা জাগাতিক আরাম আয়েশের কথা ভুলে ইসলামের জন্য নিবেদিত হয়েছিলেন।
হজরত মহানবির (সা.) রাতের নামাজের দোয়া তাদের ওপর এমন প্রভাব পড়েছিল যে, যারা রাসুলের প্রাণ নিতে সদা প্রস্তুত ছিল আর সেই তারাই মহানবির (সা.) জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যান। মহানবির আদর্শে তার প্রিয় সাহাবিরাও এমনভাবে আদর্শবান হয়েছিলেন, যাদের নামাজ দ্বারা পৃথিবীতে জান্নাতের সুবাতাস প্রবাহিত হয়েছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্য এটাই, হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর অবর্তমানে কালের পরিক্রমায় মুসলিম উম্মাহতে সেই সব নামাজির সংখ্যা অনেক কমে যায়, যার ফলে পৃথিবীতে জান্নাতের যে সুবাতাস প্রবাহিত হয়েছিল তা কমে যায়। আর তাই তো জান্নাত স্বাদৃশ্য পৃথিবীটা যেন আজ জাহান্নামের অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে।
নামাজের প্রতি মুসলিম উম্মাহর অবজ্ঞা-উদাশীনতার ফলে পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে জাহান্নামের দাবানল প্রজ্বলিত হয়েছে। কোথাও যেন শান্তি নেই, সর্বত্রই যেন অশান্তি। সব ধরনের অশান্তি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল সেই এক অদ্বিতীয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে সিজদাবনত হওয়া।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে হৃদয় মন পরিষ্কার করে তার ইবাদত করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস