‘রুহ’ শব্দটি আরবি ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, যার অর্থ আত্মা বা প্রাণশক্তি। এটি একটি অদৃশ্য সত্তা যা মানুষের দেহ থেকে পৃথক এবং জীবনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। রুহের ধারণাটি প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিতে আলোচিত হচ্ছে। মানবজীবনের মৌলিক প্রশ্ন—‘জীবনের উদ্দেশ্য কী?’ এবং ‘মৃত্যুর পর কী ঘটে?’—এগুলো রুহের সঙ্গে সম্পর্কিত। রুহের অস্তিত্ব, প্রকৃতি এবং তার স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর ভাবনা এবং অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: রুহের বৈচিত্র্য
ইসলাম
ইসলামে রুহের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনে (সুরা আল-ইসরা, আয়াত ৮৫) বলা হয়েছে: ‘তারা তোমাকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, রুহ আমার প্রভুর আদেশ থেকে এসেছে, আর তোমাদের খুব সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে।’ ইসলাম অনুসারে, রুহ স্রষ্টার এক গোপন সৃষ্টি, যার প্রকৃতি মানব জ্ঞান দ্বারা সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব নয়। হাদিসে বলা হয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে দেহ তৈরি হয় এবং তারপর রুহ প্রবেশ করে। মৃত্যুর পর রুহ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরকালে রুহের হিসাব নেওয়া হয়।
হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্মে রুহ বা আত্মা অমর এবং পরমাত্মার অংশ হিসেবে দেখা হয়। এটি জন্ম-মৃত্যুর চক্র (সংসার) থেকে মুক্তি পেয়ে মোক্ষ লাভ করে, যেখানে আত্মা পরম সত্যের সাথে এক হয়ে যায়।
খ্রিস্টধর্ম
খ্রিস্টধর্মে রুহকে স্রষ্টার উপহার হিসেবে দেখা হয়। এটি মৃত্যুর পরও চিরকাল বেঁচে থাকে এবং স্বর্গ বা নরকে অবস্থান করে। এটি স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং পরবর্তী জীবনের এক অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত।
বৌদ্ধধর্ম
বৌদ্ধধর্মে রুহের ধারণা সরাসরি প্রাধান্য পায় না। এখানে চেতনার ধারাবাহিকতা এবং কর্মফল (কর্ম) গুরুত্ব পায়, যেখানে আত্মার পরিণতি নির্ধারিত হয় তার কর্মের ওপর।
বিজ্ঞান এবং রুহ: চেতনাবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা
বিজ্ঞান, বিশেষত চেতনাবিজ্ঞান এবং মনস্তত্ত্ব, রুহের অস্তিত্ব এবং প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপন করেছে। যদিও বিজ্ঞান রুহের অস্তিত্বকে সরাসরি প্রমাণ করতে পারেনি, তবে এই বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা রয়েছে:
• চেতনাবিজ্ঞান: বিজ্ঞানীরা চেতনা, স্মৃতি এবং ব্যক্তিসত্তাকে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। যদিও এর প্রকৃতি এবং উৎপত্তি একটি রহস্য, এটি রুহের ধারণাকে ব্যাখ্যা করার একটি উপায় হতে পারে।
• মৃত্যুর নিকট অভিজ্ঞতা (NDE): অনেক মানুষ মৃত্যুর নিকট অভিজ্ঞতার সময় আলো দেখার বা আত্মার উপস্থিতি অনুভব করার কথা বলেছেন। বিজ্ঞানীরা এটি মস্তিষ্কের শেষ মুহূর্তের ক্রিয়ার ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, তবে এটির সঙ্গে রুহের অস্তিত্বের সম্পর্ক এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
রুহের কল্পনা: সংস্কৃতির প্রতিফলন
মানুষ রুহকে নানা প্রেক্ষাপটে কল্পনা করেছে:
• লোককাহিনী: বিভিন্ন সংস্কৃতিতে রুহ বা আত্মাকে ভূত, প্রেত বা অমর সত্তা হিসেবে দেখা হয়েছে। এখানে রুহের উপস্থিতি মৃত্যু বা জীবন পরবর্তী অবস্থার প্রতিফলন।
• আধুনিক কল্পনা: সিনেমা, সাহিত্য এবং গেমিং-এর মাধ্যমে রুহকে জীবনের পরবর্তী স্তরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে এটি মৃত্যুর পরের পৃথিবীতে চলমান থাকে।
• দার্শনিক দৃষ্টিকোণ: দার্শনিকরা রুহকে মানুষের অস্তিত্বের একটি গভীর রহস্য হিসেবে ভাবেন। এটি চেতনাকে নির্দেশ করে এবং কখনও কখনও এটি স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত হয়।
রুহের অস্তিত্ব: জীবন্ত বা মৃত?
রুহ নিজে জীবন্ত নয় বরং জীবনের কারণ হিসেবে কাজ করে। এটি দেহে অবস্থান করলে মানুষ জীবিত থাকে এবং বিচ্ছিন্ন হলে মৃত্যু ঘটে। অতএব, রুহকে জীবনের মৌলিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং রুহ: সম্পর্ক
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, রুহ সরাসরি স্রষ্টার আদেশে সৃষ্ট। অনেকেই মনে করেন যে, রুহের অস্তিত্বই স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ। রুহ চেতনা, নৈতিকতা এবং আত্মপরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করে।
রুহের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন: আধ্যাত্মিক পথ
রুহের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বিভিন্ন আধ্যাত্মিক উপায় হতে পারে:
• ধ্যান ও আত্মানুসন্ধান: ধ্যান বা মেডিটেশন মানুষের চেতনার গভীরে প্রবেশ করতে সহায়তা করে, যেখানে রুহের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
• প্রার্থনা বা দোয়া: প্রার্থনা বা দোয়া স্রষ্টার কাছে যাওয়ার এবং রুহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
• স্বপ্ন ও অন্তর্দৃষ্টি: ধর্মীয় বিশ্বাসে, স্বপ্ন রুহের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়, যা স্রষ্টার বার্তা বা গাইডেন্স হতে পারে।
রুহ এবং ‘অদৃশ্যকরণের ক্ষমতা’
রুহের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি চিত্তাকর্ষক ধারণা হলো তার অদৃশ্যকরণের ক্ষমতা। তবে এটি কোনো শারীরিক অদৃশ্যতা নয়, বরং মানসিক বা আধ্যাত্মিক স্তরে থাকা অদৃশ্যতা। ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে রুহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন একজন মানুষের চেতনার এমন স্তরে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি করতে পারে, যেখানে সে ইন্দ্রিয় জগতের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে।
রুহের ক্ষমতা: বাস্তবতা এবং আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা
রুহ মানব চেতনা ও মানসিক স্তরের সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করতে সহায়তা করে এবং নতুন জ্ঞান ও সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। তবে এটি ভৌত বাস্তবতার বাইরে, এক আধ্যাত্মিক অবস্থান থেকে প্রভাবিত।
সংক্ষেপে রুহের ওপর এ টু জেড বিশ্লেষণ দিলাম;
রুহ বা আত্মা একটি এমন গভীর ও জটিল ধারণা, যা মানবিক জ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতায় বারবার আলোচিত হয়েছে। রুহ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘আত্মা’ বা ‘চেতনা’ হলেও এটি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]
চলবে...
এমআরএম/এএসএম