মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
ভালোবাসার পাখি লাভবার্ড—কেউ কেনেন, কেউ শুধু ভালোবাসেন। এরা সুন্দর দেখতে। এদের বৈচিত্র্যময় জীবন মুগ্ধ করে সবাইকে। শ্রাবণের ঝিরঝিরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে অসংখ্য পাখিপ্রেমী গত ৭-৮ আগস্ট জড়ো হয়েছিলেন ঢাকার কাকরাইলের আইডিইবি ভবনে। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় সবার জন্যই সুবিধাজনক হয়েছিল।
বর্ণিল সাজে সেদিন সেজেছিল আইডিইবির মাল্টিপারপাস হল রুম। লাভবার্ডের ব্যানার, পোস্টার, বোর্ড কেটে তৈরি করা লাভবার্ডস— আরও কত কী। এ যেন পাখির এক ভিন্ন জগৎ। লম্বা সারিতে ছোট ছোট সাদা খাঁচায় লাভবার্ড এদিক-সেদিক উড়ছে। খাঁচার সামনে এসে ঠোঁট বের করে যেন সবাইকে ডাকছে। কারও কারও চোখ অপলক লেগে আছে কিছু লাভবার্ডের ডিগবাজির দিকে। আবার অতি উৎসাহী কেউ কেউ খাঁচায় আঙুল দিয়ে পাখিকে আদর করতে গিয়ে ঠোকর খেয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেন।
খাঁচায় পাখিই শুধু নয়। পাখির বর্ণনা ও সিরিয়াল নাম্বার সবই লেখা আছে। রং-বেরঙের ফিতা, লাভবার্ড অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাজ দিয়ে খাঁচাগুলো সাজানো ছিল। যেন পাখি নিয়ে একদমই না জানা মানুষটি এগুলো পড়ে জানতে পারবেন। পাশে পাখির মালিক তো ছিলেনই। যে কারো যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে সদা প্রস্তুত।
লাভবার্ড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের ন্যাশনাল লাভবার্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫ আয়োজন করে। চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা পাখি দেখা এবং জানার সুযোগ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা অবধি এ আয়োজন খোলা ছিল। ৭ আগস্ট দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাখিপ্রেমীরা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য পাখি নিয়ে আসেন। ৯টি প্রজাতির ৪১ মিউটেশনের পাঁচ শতাধিক পাখি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন পাকিস্তান থেকে আসা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লাভবার্ডস বিশেষজ্ঞ আদনান সালিম। তিনি প্রতিটি মিউটেশনের পাখি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার করেন। কোনো এক জাতের জন্য তৃতীয় পুরস্কার দেওয়ার মতো পাখি খুঁজে না পেয়ে কাউকেই পুরস্কার দেননি। তিনি বাংলাদেশে লাভবার্ডস নিয়ে এত সুন্দর গোছানো আয়োজনের প্রশংসা করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এ ধরনের আয়োজন পাখির কোয়ালিটি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। লাভবার্ডসে বাংলাদেশে অনেক সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি।
এমন কথা লাভবার্ডস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি নাহিদ কায়সার শুভর মুখেও শোনা যায়। তিনি সরকারি সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশ থেকে আন্তজার্তিক মানের লাভবার্ডস রপ্তানি করা সম্ভব বলে জানান। তিনি বলেন, ‘বিজয়ীদের সার্টিফিকেট, মেডেল দেওয়াই নয়। তারা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পাখির কোয়ালিটি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। উন্মুক্ত সেমিনারে লাভবার্ডস নিয়ে অনেক মূল্যবান তথ্য জেনেছেন।’ ৮ আগস্ট পাঁচটার পর আদনান সালিম সেমিনারে লাভবার্ডস নিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত পেশ করেন। আগ্রহীদের প্রশ্নের জবাব দেন।
আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় যেসব নিয়ম-কানুন মানা হয়। তার সবটাই হয়েছে। পায়ে ক্লোজ রিং না থাকায় ‘বেস্ট ইন শো’ হতে পারেনি একটি পাখি। বিচারকের বিবেচনায় ৪টি পাখি পুরস্কৃত হয় দেবাশীষ বড়ুয়ার। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজন পাখিপ্রেমীদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি নতুন পাখি পালক সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে।’
আয়োজনে বেস্ট ইন শো পাখি নির্বাচিত হয় নাজমুল আলমের পার ব্লু অপালাইন ফিসার লাভবার্ড। তিনি এন জেড বার্ডসের মালিক। তিনি এত সুন্দর আয়োজনের জন্য লাভবার্ড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
ঝিনাইদহ থেকে এসেছিলেন কৃষিবিদ ও লাভবার্ডস পালক শফিক বিল্পব। তিনি বলেন, ‘পাখি পালনে ভালো করতে হলে, পাখির কোয়ালিটি বুঝতে হলে এ রকম প্রতিযোগিতায় আসা খুব দরকার। ভালো মানের পাখির ধারণা নিতেই আমার আসা। বিশ্বমানের জাজমেন্ট ও সেরা পাখির কেয়ালিটির তথ্যগুলো জানতে পেরেছি আদনান সালিমের কাছ থেকে।’
লাভবার্ড পালনে নারীরা পিছিয়ে নেই। সংসার, পড়াশোনা সব কিছু সামলে তারা পাখি পালনে ভালো করছেন। সে রকমই একজন নাহিদা শম্পা। তিনি ডিইসি গ্রিন অপলাইনে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেন পান। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কেয়া অনেক আগে থেকেই লাভবার্ড পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘লাভবার্ড আমার জীবনে বৈচিত্র্য এনেছে। ক্লাস আর পড়াশোনার চাপে আগে প্রচুর একঘেয়েমি লাগতো। এখন অবসরে লাভবার্ডদের দেখাশোনা করি। এতে মানসিক শান্তি পাই, মনটা ফ্রেশ লাগে।’
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া মেহজাবীন এত পাখি একসঙ্গে দেখে খুব খুশি হয়। সে তার বাবার কাছে এক জোড়া লাভবার্ডস কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করে। ছেলে তুষারকে নিয়ে পাখি দেখতে আসেন সরকারি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘লাভাবার্ডস যে এত সুন্দর। এতদিন জানতাম না। আমার ভালো লেগেছে। আমি ছেলেকে এক জোড়া লাভবার্ডস কিনে দেবো।’
লাভবার্ডসপ্রেমী মাহিন জানায়, আগে সারাক্ষণ গ্যাজেট নিয়ে পড়ে থাকতো। পাড়ার বাজে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিতো। তার বাবা লাভবার্ডস কিনে দেওয়ার পর এসব বাজে অভ্যাস নেই। পড়াশোনার ফাঁকে পাখির সঙ্গেই কাটে। লাভবার্ডসের ভালোবাসায় তার জীবন বদলে গেছে।
ব্যস্ত নাগরিক জীবনে পোষাপাখি লাভবার্ডস নিয়ে এ আয়োজন তাপদাহে এক পশলা বৃষ্টির মতো দর্শনার্থীদের মন ও প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে। তারা বলছেন, পোষাপাখি নিয়ে এ ধরনের আয়োজন আরও দেখতে চান। পাশাপাশি পোষাপাখি সেক্টরের বিকাশে সরকারি সহযোগিতার প্রত্যাশা করেন এ সেক্টরের অভিজ্ঞরা।
এসইউ/এএসএম